Mahfuzur Rahman Manik
ইলন মাস্কের 'টুইটার চ্যালেঞ্জ'

মূল লেখক: জেনিফার রুবিন

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

টুইটার সোমবার (২৫ এপ্রিল ২০২২) ঘোষণা করেছে- এর পরিচালনা পর্ষদ ইলন মাস্কের ৪৪ বিলিয়ন ডলারের অফার গ্রহণ করেছে। তার মানে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে প্ল্যাটফর্মটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বিশেষভাবে তার রাজনীতিকে হারাতে ভূমিকা পালন করেছে; সেই টুইটার ব্যাপক জল্পনাকল্পনার জন্ম দিয়ে ইলন মাস্কের মালিকানায় যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে ব্যথা তার ঘাড়ে নিয়েছেন, সে জন্য তিনি কতটা প্রস্তুত। ইলন মাস্ক টুইটার নিয়ে তার ভিশন ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, 'স্বাধীন মত হলো একটি কার্যকর গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান। টুইটার হলো সেই ডিজিটাল ক্ষেত্র; ভবিষ্যৎ মানবতার প্রশ্নে যে বিতর্ক চলমান সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।' তিনি বলেন, 'আমি টুইটারকে আরও ভালো অবস্থানে নিতে চাই। নতুন ফিচার যুক্ত করা, আস্থা বাড়ানোর লক্ষ্যে এর অ্যালগরিদম উন্মুক্ত (ওপেন সোর্স) করা, স্প্যাম প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং সেই সঙ্গে সব ব্যবহারকারীর পরিচয় নিশ্চিতের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে সে লক্ষ্য অর্জিত হবে। টুইটারের সক্ষমতা অবিশ্বাস্য এই সম্ভাবনাকে উন্মোচন করতে কোম্পানি এবং টুইটার কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করার জন্য আমি মুখিয়ে আছি।' বাস্তবে কী ঘটে তা আমরা দেখব।
বলাবাহুল্য, প্রাইভেট কোম্পানিটির মালিকানা ইলন মাস্ক নেওয়ার মাধ্যমে টুইটারের বহুমুখী সমাস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। তথ্যমতে, মাস্ক ১৫ বছরের পুরোনো কোম্পানিকে নতুন করে দাঁড় করাতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। কয়েক বছর ধরে টুইটার ব্যবহারকারীর প্রবৃদ্ধি স্থির হয়ে আছে। তার অসম আয়ও স্পষ্ট। বিজ্ঞাপন শিল্পের কর্মকর্তারা সোমবার সতর্ক করে বলেছেন, মাস্ক যদি কনটেন্টের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন, ভুয়া তথ্য গ্রহণ করেন এবং বিষাক্ত উপাদান বিকাশের সুযোগ দেন তবে বিজ্ঞাপনদাতারা টুইটার ছেড়ে ভাগবেন। মাস্ক নিজেও হয়তো এ ব্যাপারে টুইটারের প্রায় সাড়ে সাত হাজার কর্মীর বাধার মুখে পড়তে পারেন। ওইসব কর্মীর অনেকেই মাস্কের স্বাধীন মতপ্রকাশের রাজনীতির 'ব্র্যান্ড' পছন্দ করেন না।
ইলন মাস্কের স্বাধীন মতপ্রকাশের বক্তব্য দ্বারা আবার 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' নতুন করে সামনে আসছে কিনা তা দেখতে হবে। তবে তার নেতৃত্ব গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি বা আমেরিকার রিপাবলিকানদের জন্য সুবিধাজনক হবে কিংবা তাদের কৌশল অধিক মনোযোগ আকৃষ্ট করে বলে তা বিরক্তির কারণও হতে পারে। সোমবার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি টুইটারে ফিরবেন না এবং তিনি তার ওয়েবসাইট ট্রুথ সোশ্যালের সঙ্গে থাকবেন। তবে এটা এখনও স্পষ্ট নয়, কারণ টুইটারে এত বেশি ব্যবহারকারীর প্ল্যাটফর্মে না ফেরার লোভ তিনি সামলাতে পারবেন বলে মনে হয় না।
তবে টুইটারের নতুন মালিকানায় কে আসছে তা আমেরিকার দলীয় রাজনীতির মূল উদ্বেগ নয়। অন্তত সরাসরি তো নয়ই। যদি টুইটার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে স্বাগত জানায়, সে ক্ষেত্রে তার অনুসারীর মাধ্যমে ভুয়া তথ্য প্রসারের আশঙ্কা থাকবে। ফলে টুইটারকে সতর্ক থাকতে হবে সেখানে সন্ত্রাসী হুমকি, অপরাধের বর্ণনা, পরিকল্পিত ঘৃণার বক্তব্য কিংবা এমন আরও কিছু আছে কিনা। এখানে শুধু কনটেন্ট বা আধেয় নিয়ন্ত্রণের বিষয় নয় বরং কতটা মডারেট করলে তা বিজ্ঞাপনদাতা, ব্যবহারকারী কিংবা রেগুলেটরদের সন্তুষ্ট করবে।


কৃষ্ণাঙ্গদের রাজনৈতিক অধিকার ও বর্ণবাদ বিলোপ সাধনে আন্দোলনকারী এনএএসিপি প্রেসিডেন্ট ডেরিক জনসন তার এক বার্তায় লিখেছেন, 'ইলন মাস্কের স্বাধীন মতপ্রকাশের কথা বড়ই সৌন্দর্যময়। তবে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানো বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। বিভ্রান্তিকর তথ্য, ভুল তথ্য ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের স্থান টুইটারে থাকা উচিত নয়। উন্মাদনা টুইটারে ফের ফেরানো ঠিক হবে না। টুইটারকে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা, গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন বিভ্রান্তির কারখানা বানানো যাবে না।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের গণতন্ত্রের সুরক্ষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মধ্যবর্তী নির্বাচন সামনে আসছে। ফলে ইলন মাস্কের জীবন যখন ঝুঁকিতে তখন আমেরিকার গণতন্ত্রও বাইরে নয়।'
ইলন মাস্কের ঘোষণার ক'দিন পরই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এমন নতুন আইন নিয়ে কথা বলছে, যা সরাসরি মাস্কের 'ওয়াইল্ড ওয়েস্ট' সামাজিক যোগাযোগের ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে। এনপিআর-এর প্রতিবেদন অনুসারে, গুগল ও ফেসবুকের মতো বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিকে তাদের প্ল্যাটফর্মকে আরও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্যবহারকারীদের ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক বক্তব্য থেকে সুরক্ষা করা যায়। বিভ্রান্তিমূলক তথ্য এবং অনলাইনের অন্যান্য ক্ষতিকর তথ্যও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই আইনের আওতায় পড়বে, যা শনিবার সেখানে আইনসভায় পাস হয়। এই আইন অনুসারে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই আইনের মাধ্যমে সরকার কোম্পানিগুলোকে তাদের যে কোনো আধেয় মুছে দেওয়ার কথা বলতে পারবে। বিশেষ করে যেগুলো বেআইনি। একই সঙ্গে যেসব আধেয় সন্ত্রাসবাদ প্রসারে ভূমিকা রাখছে; শিশুদের যৌন হয়রানিতে ফেলছে; বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ব্যবসায়িক কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত। এই আইনের ধারা মাস্কের জন্য এক অনতিক্রম্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। হয় তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার ত্যাগে বাধ্য করতে পারে কিংবা সেখানকার আইন অনুযায়ী তাকে চলতে হবে; যার পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপীই আমরা হয়তো দেখতে পাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও পড়তে পারে।
ইলন মাস্কের টুইটার অধিকারী হওয়ার বিষয়টি তার প্রতিষ্ঠান টেসলার অংশীজনের চেয়েও কম লাভজনক হতে পারে। এর মাধ্যমে বৈদুতিক গাড়ি শিল্পে নতুন প্রবেশকারীদের পক্ষ থেকে টেসলা নতুন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে পারে। মাস্কের টুইটারের অবস্থানের জন্য প্রগতিশীল গ্রাহকদের কাছে টেসলা অনাকর্ষণীয় হতে পারে। তারা কি ট্রাম্পের জন্য সুবিধাজনক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অধিকারীর প্রতিষ্ঠানের পণ্য কিনতে আগ্রহী হবে?
যারা ইলন মাস্ককে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ত্রাতা কিংবা শয়তানের অবতার হিসেবে দেখছেন, তারা এখনও বড় খেলোয়াড় হিসেবে ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গকে দেখতে পারেন। ফেসবুক সব দিক থেকেই টুইটারের চেয়ে বৃহৎ এবং তারা গণতন্ত্র ও সভ্য সমাজের ব্যাপারে অধিক দায়িত্বশীল; অনুমেয় ভবিষ্যৎ সেখানেই বেশি।
জেনিফার রুবিন: মার্কিন কলাম লেখক; ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।