বই পড়ার গুরুত্ব এবং না পড়ার কুফল নিয়ে আলোচনা কিংবা সমালোচনা কম হয়নি। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে এ আলোচনা বেশি দেখা যায়। একুশের মাসব্যাপী গ্রন্থমেলার কারণেই বলা চলে আমাদের বইয়ের আয়োজন অনেকটা ফেব্রুয়ারির মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রকাশকরা এ সময়েই অধিকাংশ প্রকাশ করেন। পাঠকও এ সময়ে নতুন বই খোঁজেন। সেদিক থেকে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত ২৩ এপ্রিলের ওয়ার্ল্ড বুক অ্যান্ড কপিরাইট ডে তথা বিশ্ব গ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবসটির ভিন্ন মাত্রা এখানেই, অন্তত ফেব্রুয়ারির বাইরের একটি দিনে বইয়ের আলোচনা হচ্ছে।
বইয়ের আলোচনা বহুমাত্রিক। ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে দিবসটির পেজ খুললেই একটা খোলা বইয়ের ছবি সামনে পড়বে, যার ওপর লেখা- রিড ... আনটিল নো স্ট্রেঞ্জারস রিমেইন। অর্থাৎ যতক্ষণ অজানা বা অচেনা বিষয় থাকবে ততক্ষণ পড়ুন। মানুষের জ্ঞান সীমিত; যে বিষয়ই আসুক, মনে হয় কত অজানা রে। কেউ সারা জীবন দিনের অধিকাংশ সময় পড়ায় ব্যয় করলেও কি অজানা সব জানা হয়ে যাবে? বলা বাহুল্য, দিবসটির পেজে ইউনেস্কো আরও লিখেছে, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন পড়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ! কারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা জানতে এবং বৈষম্য ও গুজবের মতো সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পড়া জরুরি; বই এখানে অন্যতম অস্ত্র। বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে বই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষ নানা কারণে বই পড়ে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাসের জন্য পড়েন; চাকরিপ্রার্থী চাকরি পাওয়ার জন্য পড়েন; শিক্ষক পড়ানোর জন্য পড়ে; অবসরে অনেকে পড়েন বিনোদনের জন্য। বই সবাইকে সমানভাবে সব ধরনের সেবা দিয়ে যায়। সৈয়দ মুজতবা আলী অবশ্য বলেছেন, বই পড়া হলো চোখ বাড়াবার পন্থা। কিন্তু যাদের চোখই নেই তারা চোখ বাড়াবে কীভাবে! যাদের সাক্ষরজ্ঞান নেই, তারা চোখ থাকতেও এক প্রকার অন্ধ। গত বছরের সাক্ষরতা দিবসের (৮ সেপ্টেম্বর) হিসেবে, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সে হিসাবে এখনও দেশের অন্তত চার কোটি মানুষ নিরক্ষর। বই নিয়ে আমরা যত আলোচনা করি কিংবা বাংলা ভাষা নিয়ে যত গর্বই করি, সব মানুষকে সাক্ষর করা ছাড়া এসব আলোচনা অনর্থক নয় কি?
তার পরও যারা পড়তে পারেন, তাদের অনেকেই পড়েন না। পাঠাভ্যাসের ক্ষেত্রে বাঙালি যে পিছিয়ে তা সৈয়দ মুজতবা আলী কয়েক দশক আগে যেভাবে বলে গেছেন তা এখনও অপ্রাসঙ্গিক নয়। তিনি বলেছেন, 'বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না।' তবে এর মধ্যেও অনেক পাঠক আছে। বই পড়েন। বই কেনেন। সেজন্যই আমরা দেখছি, প্রতি বছর নতুন নতুন বই প্রকাশ হয়। লেখকরা বই লিখেন; প্রকাশকরাও বই প্রকাশে আগ্রহী হন। লেখক তার জ্ঞান ও সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়ে বই লিখেন। বইয়ের মধ্যে যে মণিমুক্তা লুক্কায়িত রয়েছে তা হচ্ছে লেখকের জ্ঞান, গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ফসল।
লেখক তার মেধা প্রয়োগ করে বই সৃজন করেন বলেই এটি মেধাসম্পদ। বস্তুত বই দিবসের সঙ্গে এজন্যই কপিরাইটের বিষয়টি এসেছে। বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব গুরুত্বপূর্ণ বলেই তার মালিকানা নিবন্ধনের জন্য যেমন কপিরাইট আইন আছে, তেমনি দেশে সরকারি কপিরাইট অফিসও রয়েছে। সেখানে যে কেউ সৃজনশীল মেধাস্বত্বের নিবন্ধন করতে পারেন। বইয়ের ক্ষেত্রে কপিরাইট যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি লেখকের সম্মানীও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফলে কপিরাইটের পাশাপাশি লেখকের যথাযথ সম্মানীর বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে।
বই পড়া, বই প্রকাশ ও বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতেও দিবসটি ভূমিকা পালন করুক। একই সঙ্গে যারা এখনও নিরক্ষরতার অন্ধকারের মধ্যে পড়ে আছে, তাদের সে অভিশাপ থেকে উদ্ধার করে বইয়ের সাহায্যে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার মধ্যেই রয়েছে বই ও কপিরাইট দিবসের সার্থকতা।
- সমকালে প্রকাশিত ২৩ এপ্রিল ২০২২
- ছবি: ইন্টারনেট