বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে যেভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে মারধরের ঘটনা ঘটেছে, তা যে কাউকে হতবাক করবে। একজন অভিভাবক যেখানে শ্রেণি কার্যক্রম চলার সময় শিক্ষকের অনুমতি না নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন না, সেখানে ওই অভিভাবক শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে অন্যায়ভাবে তিনজন শিক্ষার্থীকে মেরেছেন! তাতেও তিনি ক্ষান্ত হননি; প্রতিবাদ জানানোয় শিক্ষকের গায়েও হাত তুলেছেন। এমনকি ওই নারী শিক্ষকের শ্নীলতাহানি করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। সোমবার সমকালে প্রকাশ, ভয়-লজ্জায় ওই বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক বদলি চাইছেন।
বলা বাহুল্য, এ ঘটনার পর শিক্ষকরা বিদ্যালয়টিকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। যেমনটি ওই বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেছেন, 'ক্লাসরুমে ঢুকে কেউ নারী শিক্ষককে মারধরসহ তার শ্নীলতাহানি করতে পারে, সেটা কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু আমাদের স্কুলে সেটাই হয়েছে। এ ঘটনার পর ক্লাসরুমটাকে কি আমরা আর নিরাপদ ভাবতে পারি?' প্রশ্ন হলো, একজন অভিভাবক কীভাবে এমন সাহস করতে পারেন। তার সন্তান যদি অন্য সহপাঠীর দ্বারা আক্রান্ত হন, সেটা অভিভাবক বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক কিংবা প্রধান শিক্ষকের কাছে বলবেন। তারা বিচার করতে ব্যর্থ হলে স্থানীয় প্রতিনিধি অথবা শিক্ষা প্রশাসনে নালিশ করতে পারেন। তিনি তার ধার না ধরে নিজেই বিচারের দায়িত্ব নিয়ে নিলেন! এর মাধ্যমে একই সঙ্গে একাধিক অন্যায় করেছেন ওই অভিভাবক। যদিও এ ঘটনায় তিনি আটক হয়েছেন। আমরাও তার বিচার চাই।
কাকতাল কি-না জানি না, ২৯ মার্চের অভিভাবকের এই কাণ্ডের আগে ওই বিদ্যালয়ে আরেকজন শিক্ষক লাঞ্ছনার শিকার হন। ১৬ মার্চের ম্যানেজিং কমিটির সভায় বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে একটি বেসিন সংযোজনের প্রস্তাব করায় এক নারী শিক্ষকের সঙ্গে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বিবাদে জড়ান। একপর্যায়ে তিনি ওই শিক্ষককে মারতে উদ্ধত হন। ওই ঘটনায় প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে দুপচাঁচিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। অবশ্য পরে উপজেলা চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে ম্যানেজিং কমিটি প্রধান শিক্ষক ও সংশ্নিষ্ট শিক্ষককে বদলির সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে ওই ঘটনার একটি 'সমঝোতা' করা হয়।
দুপচাঁচিয়ার ওই বিদ্যালয়ের দুটি ঘটনাই নয়, আমরা সারাদেশে এর আগেও এমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা দেখেছি, যেখানে শিক্ষকরা নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। কোথাও ম্যানেজিং কমিটির দ্বারা, কোথাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দ্বারা, আবার কোথাও অভিভাবকের দ্বারা। এমনকি ছাত্রনেতাদের দ্বারাও শিক্ষক আক্রান্ত হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
আমরা জানি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সারাদেশে কতটা আন্তরিকভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। রোববার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদনে এসেছে, দেশে কোথাও মাত্র একজন শিক্ষক দিয়েও চলছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। কেবল শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনাও নয়; কোথাও প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় দপ্তরি, আয়া হতে শুরু করে দারোয়ানের দায়িত্বও শিক্ষকদের পালন করতে হয়। তারা দাবি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না পেলেও নিজেদের দায়িত্ব পালনে কার্পণ্য করেন না। প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী 'এনরোলমেন্টের' যে অর্জন, এর পেছনে শিক্ষকদের অবদান ভোলার নয়। এমনকি নির্বাচনসহ জাতীয় যে কোনো দায়িত্বও তারা পালন করে থাকেন।
অস্বীকার করা যাবে না, কাজী কাদের নেওয়াজ তার কবিতায় বাদশাহ আলমগীরের যে 'শিক্ষাগুরুর মর্যাদা' তুলে ধরেছেন, তা এখন বিরল। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি- এমন অভিযোগ কারও কারও ক্ষেত্রে উড়িয়ে দেওয়া না গেলেও সার্বিকভাবে সমাজে যে পরিবর্তন হয়েছে, তা উল্লেখযোগ্য। কারণ এখন মর্যাদার ক্ষেত্রে বিদ্যার চেয়ে ক্ষমতা আর অর্থই অনেক ক্ষেত্রে প্রধান।
বগুড়ার ঘটনাপ্রবাহে হয়তো ওই অভিভাবকের অপরাধই আমরা দেখব। কিন্তু এর পেছনে সমাজও কতখানি দায়ী, তাও দেখা দরকার। শিক্ষকরা কেন বারবার প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক কিংবা ছাত্রনেতাদের হাতে জিম্মি হবেন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা শিক্ষকদের কাছে আসলেই কেন সবাই উদ্ধত হন; সাপের পাঁচ পা দেখেন? এ প্রশ্ন যতটা সামাজিক ততটাই রাজনৈতিক। সমাধান সেভাবেই খুঁজতে হবে। তবে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে।