Mahfuzur Rahman Manik
বাংলাদেশের উন্নতি থেকে পাকিস্তানের শিক্ষা

মূল: আবিদ হাসান

বর্তমান সরকারসহ পাকিস্তানের সব সরকারই সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাপী ধরনা ধরেছে। আমরা ঋণে হাবুডুবু খাচ্ছি এবং প্রবৃদ্ধির হার একই বৃত্তে আবদ্ধ। অদূর ভবিষ্যতে এভাবেই চলবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, কোনো সরকারই পাকিস্তানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের গভীরে দৃষ্টি দেয়নি। অথচ ২০ বছর আগেও এটি অকল্পনীয় ছিল- বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রবৃদ্ধি বজায় থাকলে দেশটি ২০৩০ সালে অর্থনীতির বড় শক্তি হয়ে উঠবে। আর পাকিস্তানের এই দুরবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ থেকে আমাদের সহায়তা নেওয়ার অবস্থা তৈরি হবে।

পাকিস্তানের এই মন্দাবস্থার দায় আমাদেরই। যদিও আমাদের নেতারা সহজেই আমাদের শত্রু এবং আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের দোষ দিয়ে থাকেন। এটা অস্বীকার করা যাবে না, আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংকের দুর্বল নীতি ও মন্দ ঋণের গভীর খাদে রয়েছে পাকিস্তান। দুর্নীতি ছাড়াও সন্ত্রাসবাদের প্রভাব রয়েছে অর্থনীতিতে। কর্মক্ষমতায় দুর্বলতার ফলে দায়িত্বহীন ও অযৌক্তিক নীতি এবং উদ্যমহীন সংস্কার করা হচ্ছে। বেপরোয়া নীতির দুটি উদাহরণ হলো :জাতীয় ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থের অধিক সরকারি ব্যয় এবং রপ্তানির তুলনায় অনেক বেশি আমদানিনির্ভরতা বাইরের ঋণও বাড়িয়ে তুলছে।

নানা দিক থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে সাযুজ্য থাকায় বাংলাদেশের সাফল্য একটি ভালো উদাহরণ। একই ধর্ম, কাজের ক্ষেত্রে নৈতিকতায় ঘাটতি, নোংরা রাজনীতি, সুশাসনের অভাব, দুর্বল জনপ্রশাসন ব্যবস্থা, দুর্নীতি ও অভিজাতদের তোষণের নীতিতে দুই দেশের অবস্থান প্রায় সমান হলেও বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। গত ২০ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে কয়েক গুণ। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় যেখানে দুই হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার, সেখানে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় মাত্র এক হাজার ১৯০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য অর্জন আর পাকিস্তানের দুর্যোগের পেছনের গল্প কী?

যে কোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের গল্প আলাদা। তবে গণতান্ত্রিক দিক থেকে শক্তিশালী দেশগুলোর একটা পরিমাপক 'ওয়াশিংটন কনসেনসাস পলিসি'। এখানে কয়েকটি বিষয় রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শক্তিশালী রাজস্ব ও মুদ্রানীতি, রপ্তানি লক্ষ্য রেখে বাজার উদারীকরণ, দরিদ্রদের জন্য পরিকল্পিত ব্যয় এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সরকারের কম হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশ ভোগ করার চেয়ে সঞ্চয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে। দেশটিতে সঞ্চয়ের হার জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ, যেখানে পাকিস্তানের হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। পাকিস্তানের দায়িত্বহীন ও অপরিণামদর্শী নীতি মানুষকে অধিক ব্যয় ও আমদানিতে উৎসাহিত করে।

২০০০ সালে বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল দ্বিগুণ। আর ২০২০ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল পাকিস্তানের দ্বিগুণ। অপরিকল্পিত আমদানি ও মুদ্রা বিনিময় হার নীতির ফলে আমরা বোকার মতো বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঋণ বাড়িয়ে তুলছি। অপ্রয়োজনীয় আমদানির কারণে আমাদের সঞ্চয় ও বন্ড যেমন ব্যয় হচ্ছে, তেমনি সুদের হারও বাড়ছে। খারাপ নীতির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো ৩০০ কোটি ডলারের গাড়ি ও ফোন আমদানি এবং সমপরিমাণ টাকার ইউরোবন্ড লালন।

গত দুই দশকে বাংলাদেশের রাজস্ব ঘাটতি ছিল জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ, যেখানে পাকিস্তানের ঘাটতি দ্বিগুণেরও বেশি। ২০ বছরের বেশি সময়কালে পাকিস্তান সরকার যেখানে মাথাপিছু খরচ করেছে চার হাজার ডলার, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের খরচ ছিল তার অর্ধেক। বাংলাদেশের দ্বিগুণ খরচের পরও আমাদের অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়ন সূচক বাংলাদেশের চেয়ে অনেক নিচে।

দায়িত্বহীন রাজস্ব ও ব্যবসা নীতির ফলে যা হয়েছে :১. পাকিস্তানের মোট মাথাপিছু ঋণ রাজস্বের প্রায় ৬০০ গুণ, যা বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ। ২. বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের হার যেখানে ২০০ শতাংশ, পাকিস্তানে সেটি ৮০ শতাংশ। পাকিস্তান সরকারের অত্যধিক ঋণের ফলে ব্যক্তি খাতে ঋণে বিধিনিষেধ রয়েছে। ৩. আমাদের বাহ্যিক ঋণ রপ্তানির ৪০০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে সেটি মাত্র ৪ শতাংশ। পাকিস্তানের বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতি বিশেষত, সেবা খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে। যেখানে রাজস্ব আসে রুপিতে অথচ দায়বদ্ধতা মাপা হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগ রপ্তানি উৎপাদন পর্যন্ত নিয়ে গেছে। পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, ঋণ কমানো এবং বাংলাদেশ থেকে সাহায্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হলে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে হবে। এতে হয়তো আমাদের জাতীয় আবেগ আহত হবে, কিন্তু এখান থেকে উত্তরণের সংক্ষিপ্ত কোনো পথ নেই। বিচক্ষণ রাজস্ব ও যথার্থ মুদ্রানীতি গ্রহণ করতেই হবে।

রপ্তানি বাড়াতে পাকিস্তানকে আরও দ্বিগুণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমান ঘাটতি মেটাতে অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমাতে হবে। কর নীতি ও ব্যবসায়ী পরিবেশ এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যাতে রপ্তানিতে সর্বোচ্চ লাভ থাকে। এ জন্য জাতীয় লাভের ওপর ৫০ শতাংশ ট্যাক্স আরোপ এবং রপ্তানিতে ট্যাক্স রহিত করা যেতে পারে।

আমরা যদি সবকিছু বর্তমানে যেভাবে চলছে, সেভাবে ছেড়ে দিই, তবে এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সাহায্য গ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। তার বিপরীতে পাকিস্তানকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড় করাতে বর্তমান ক্ষমতাসীন পিটিআই নেতৃত্বাধীন সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং ঋণের পরিমাণ কমাতে সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি মৌলিক অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হবে।

 আবিদ হাসান: বিশ্বব্যাংকের সাবেক পরামর্শক; পাকিস্তানের দৈনিক দ্য নিউজ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।