Mahfuzur Rahman Manik
ইফা, তুমি পথ হারাইয়াছ?
জানুয়ারী 1, 2020

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যখন জাতি সোচ্চার, যখন সরকারি নানা অফিসে শোভা পাচ্ছে 'আমি এবং আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত'; সেখানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা) ও এর মহাপরিচালকের (ডিজি) নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কোনো প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করলেও বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটি কতটা দুর্নীতিমুক্ত, সেটি আমরা জানি না। তবে এটা অন্তত অনুধাবন করা যায়, দুর্নীতিমুক্ত করতে প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছা রয়েছে। কিন্তু যেখানে গোড়ায় পচন ধরে, অর্থাৎ খোদ প্রতিষ্ঠানপ্রধান দুর্নীতিগ্রস্ত হন, অনিয়ম ও স্বেচ্চাচারিতায় বেপরোয়া হন, সেখানে গোটা প্রতিষ্ঠানই তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ভুলে একজনের আজ্ঞাবহ ও সেবাদাসে পরিণত হতে বাধ্য। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ঠিক তা-ই হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির জন্য 'পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?' উক্তিই যথার্থ।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামের সমুন্নত আদর্শ প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে। এমন মহান উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন যখন দুর্নীতির জন্য টানা খবর হয়, তার চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কী হতে পারে! রোববার সমকালের প্রতিবেদন 'ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জেঁকে বসেছে দুর্নীতি' পড়ে যে কেউ অবাক হবেন; হেন কোনো প্রকল্প নেই যেসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়নি। এক টাকা, দুই টাকা নয়; প্রতিষ্ঠানটিতে অডিট করে প্রায় আটশ' কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের নেতৃত্বে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ। ১০ বছর ধরে তিনি প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। পুরো সময়টির তদন্তে দেখা গেছে নিয়োগে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, বেশি ব্যয়, অপচয়সহ তিনি নানা অপকর্ম করেছেন। সমকালের প্রতিবেদন বলছে, নিরীক্ষায় প্রথমে ১৩২টি অনিয়ম ও ৯০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায়। পরে ৩৬টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়। ডিজি ১০০ কোটি টাকার বেশি সরকারি কোষাগারে ফেরতও দেন।

এত বড় দুর্নীতি যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। আর সেখানে যদি একজনই অভিযুক্ত হন, তাহলে তো কথাই নেই। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুর্নীতিতে তোলপাড়ের কারণ কেবল প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, ব্যক্তির কারণেই নয় বরং কারণটি খোদ প্রতিষ্ঠানের ধরন-ধারণের জন্যও। প্রতিষ্ঠানটির নামের সঙ্গেই রয়েছে ইসলাম। আমরা জানি, অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ সামাজিক সব অপরাধের বিরুদ্ধে রয়েছে ইসলামের সতর্ক বার্তা। অন্যায়ভাবে সম্পদ আত্মসাৎ, অন্যের অধিকার হরণে ইসলামে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সে কাজটিই করেছেন। আমরা বিস্মিত, সেখানে পবিত্র কোরআন ছাপানো প্রকল্পেও দুর্নীতি হয়েছে। যেখানে কোরআন মুদ্রণ ও ক্রয়ে অনিয়ম হয়, সেখানে অন্যান্য প্রকল্পের বিষয় বলাই বাহুল্য।

প্রতিষ্ঠানে এত অনিয়ম-দুর্নীতি, সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এত ক্ষোভ, অথচ তা কি-না ধরা পড়ল মহাপরিচালকের বিদায়ের বছরে! ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান মহাপরিচালক নিয়োগ পেয়েছিলেন। দুই দফা চুক্তিতে তার মেয়াদ বাড়িয়ে এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এ বছরের জুন থেকে তার অনিয়ম সংবাদমাধ্যমে আসে। জুনের প্রথম দিকেই ইফার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ডিজির পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে তার চুক্তি বাতিলের আলোচনা হয়। তারপরও তাকে বহাল তবিয়তে রাখা হয়, তবে ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার হিসেবে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনেকের আবেগের প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রশ্নটা কেবল ইফার ডিজির জন্যই নয়। যে কোনো প্রতিষ্ঠানে যত বড় ব্যক্তিই হোন না কেন, কেউই আসলে ভুলের ঊর্ধ্বে নন। তাই সরকারের উচিত প্রত্যেকের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা। অন্তত একজন ব্যক্তির যখন মেয়াদকাল শেষ হয়, তাকে পুনর্নিয়োগের আগেই তার মূল্যায়ন করা উচিত। তা না হলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতোই অবস্থা হবে। সেটি কাম্য নয়। প্রতিষ্ঠানের মেজাজ-মর্জি ও ব্যক্তির সততা-যোগ্যতা-দক্ষতাই হওয়া উচিত দায়িত্ব লাভের বিবেচ্য বিষয়।

 

 

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।