আপাত রসকষ-আবেগহীন, ডোন্ট কেয়ার টাইপের স্বভাবে অনেক বিষয়ই আমি হজম করি। হজম শক্তি যত বেশিই থাকুক না কেন কিছু বিষয়ে নীরব থাকতে গিয়েও অনেক সময় বদহজম হয়। সেটাই বোধহয় লেখা হয়ে ওঠে। এটা ঠিক লেখা না। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কয়েকদিন নিরন্তর ভাবছি। ভাবছি দুনিয়ার জীবনটা এমনই- আসা আর যাওয়া। এর মাঝেই নানা সূত্রে নানা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়। তার সঙ্গে আবেগ, অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তার প্রস্থানে বিরহ লাগে। জানি এইটা শামীম ভাইয়ের ঠিক অগস্ত্য যাত্রা নয়। জীবনের তাগিদে দুনিয়ারই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা, এক কর্মস্থল থেকে অন্য কর্মস্থলে যাত্রা। পেশা বদল আরকি। হয়তো তিনি কাঙ্খিত জায়গাই পেয়েছেন। হয়তো এটা তার জীবনের স্বপ্নের একটা জায়গা। তারপরও ঠিক আমি কেন যেন তা মানতে পারছি না। জানি না হয়তো আমার স্বার্থের জন্যই। কাগজে কলমে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে আমার। তারও আগ থেকে এবং সর্বশেষ গত পরশু (২৯ ডিসেম্বর ১৪) পর্যন্ত একেবারে প্রিন্টেড কালিতে যার নামের সঙ্গে আমার নামটা শোভা পেত, পাঠক দেখত- সেটা আর হবে না! এটা ভাবতেই কেন যেন কষ্ট হচ্ছে। সমকালের টেলিফোনে নাগরিক মন্ত্যব্যে তার নামটা আগে দেখে অনেকেই আমাকে জিগেস করতেন- আচ্ছা, একরামুল হক শামীম টা কে। বলি আমাদের শামীম ভাই। সাংবাদিকতা এবং পড়াশোনায় আমার অগ্রজ। হয়তো তিনি জানেন না সাংবাদিকতার অনেক বিষয়ই আমি তাকে দেখে শিখেছি। সমকালে প্রকাশিত তার অনেক লেখা, ইন্টারভিউ পড়ে আমি একেবারে মুগ্ধ হলেও কোনদিন বলিনি। তারপরও আমার প্রতি তার একটা ভালোবাসা ছিলো। আমাদের উভয়েরই অগ্রজ সহকর্মী রোকন ভাই বলতেন, মানিক, সাংবাদিকতায় এরকম পরিবেশ আপনি কোথাও পাবেন না। না, সমকালের সম্পাদকীয় বিভাগে অজয়দা, সুভাষদাসহ আমাদের সবারই অ্যালমা ম্যাটার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলে না। বরং প্রত্যেকেরই পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার জন্যই তিনি এটা বলতেন।
শামীম ভাই বলেন, মানিক, সাংবাদিকতায় আসছেন- এটা বড় কঠিন জায়গা। দেখেন ভালো কোন সুযোগ থাকলে চলে যান। তেজগাঁও অফিস থেকে অনেকদিনই তার সঙ্গে রিকশায় ফার্মগেট যেতে এমন নানা উপদেশ তিনি দিয়েছেন। একসঙ্গে রিকশায় গিয়ে কখনোই তিনি ভাড়া দিতে দেননি। প্রথম প্রথম কয়েকদিন চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর বিনা বাক্য ব্যয়ে এটা আমি মেনে নিয়েছিলাম- যেন বড় ভাই হিসেবে এটা তারই অধিকার। ক্যান্টিনে কিংবা কোথাও একসঙ্গে খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শামীম ভাইকে কোনোদিনই আমি পরাজিত করতে পারিনি। আসলে কিই-বা করার ছিলো। বিজয়ই তার পাওনা। আমার কোন লেখায়, কাজে, সম্পাদনায় ভুল দেখলে বলতেন মানিক, এটা কী করেছেন। তার সে কথায় ধমক তো নয়ই বরং একটা প্রশ্রয়ের সান্তনা পেতাম। সিনিয়ররা বিশেষ করে আমাদের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান তার দায়িত্বের খাতিরে আমার ওপর ক্ষেপে গেলে অনেক সময় শামীম ভাই সেটা ঠেকাতেন। আমাকে বুঝাতেন। মাস শেষ হতে না হতেই যখন আমার পকেট খালি শামীম ভাই ছিলেন অন্যতম ভরসা। অনেক সময় তার টানাটানি থাকলেও না করেন নি।
আমার পাশের চেয়ারের এরকম একজন মানুষের চলে যাওয়া কতটা নিষ্ঠুর হলে মেনে নিবো! এ বছরেরই (২০১৪) জানুয়ারিতে যখন জুডিসিয়ালে তার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হলো তখন যদিও তাকে কংগ্রেচুলেশনই জানিয়েছে তারপরও মন থেকে চাই নাই তিনি যাক। শামীম ভাইয়ের নিয়োগে যখন দেরি হচ্ছিল, সবাই তাকে জিগেস করছেন- কবে জয়েন করছেন। আমি গোটা এক বছরে একবারের জন্যও জিগেস করিনি কবে নিয়োগ দিচ্ছে। যদিও জানতাম তিনি চলে যাবেনই। তারপরও করিনি। ভাবতাম যত বেশি তার সঙ্গে থাকা যায়। কিন্তু সে আর হলো কই। গতকালই তিনি চলে গেছেন খুলনায়। আগামীকাল বছরের প্রথম দিনই যোগ দিচ্ছেন- অ্যাসিস্ট্যান্ট জজ হিসেবে।
মন খারাপ থাকলেও আসলে আমি খুশী। আমার পাশের চেয়ারে প্রিয় শামীম ভাই না থাকলে কি হবে- এর চেয়ে বড় চেয়ারে তিনি থাকবেন। ন্যায়ের দ- থাকবে তার হাতে। সাংবাদিকতার কলম সৈনিক না হলে কি হবে- অধিকার হারা মানুষের জন্য সরাসরিই কাজ করার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন। এটা তো বিরাট ব্যাপার। এটাও তার জয়। আসলে আমি তো আপনার বিজয়ই চেয়েছি শামীম ভাই।
ফেসবুকে নোট আকারে প্রকাশিত