Mahfuzur Rahman Manik
হলের সিট রাজনীতি বনাম শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত
জানুয়ারি 28, 2012

হাসান (ছদ্মনাম) এসএসসি-এইচএসসিতে এ-প্লাস পেয়েছে। তার স্বপ্ন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। কঠোর পরিশ্রম আর পড়াশোনা করে ভর্তি পরীক্ষায় একটা ভালো মেধাস্থান নিয়ে ভর্তিও হয়েছে সে। পড়াশোনা নির্বিঘ্নে চালিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তার একটা সিট দরকার। গ্রাম থেকে আসা হাসান প্রথমে ভেবেছিল ভর্তি হলেই কর্তরর্্ৃপক্ষ তাকে সিট দেবে। বাস্তবতা দেখল ভিন্ন, সিটের জন্য বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের কাছে ধরনা দেয় সে। তারা তাকে হলে উঠিয়েছে ঠিকই, তবে রুমে নয়; বারান্দায়। বিনিময়ে ক্লাস বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের হয়ে শোডাউন করছে হাসান। তবু সিট মিলছে না। সেই ছাত্রনেতাদের (!) মনোরঞ্জন আর গেস্ট রুমের নামে নির্যাতন সহ্য করাই তার লক্ষ্য। কারণ এর চেয়ে বড় লক্ষ্য সিট পাওয়া। এত কিছুর পরও সে সিট পেয়েছে বছর দেড়েক পর। হাসান সিট পেয়েছে বটে, ইতিমধ্যে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর পার হয়ে গেছে। যে হাসান জীবনের কোনো পরীক্ষায় কখনও দ্বিতীয় হয়নি। এবার তার কোনো মেধাস্থান তো হয়নিই বরং টেনেটুনে পাস করেছে। ফলে সিটটা এখন তার কাছে শুধুই প্রহসন।
হাসানের মতো বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের অবস্থা এরকম কি-না জানা নেই। অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবারই জানা আছে। এখানে সিট পাওয়া যে কত কষ্টকর তা ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। একটা সিটের পেছনে একজন শিক্ষার্থীর কতটা শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন সহ্য করার যন্ত্রণা রয়েছে তা অকল্পনীয়। দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বল সে, তাকে নিয়ে ছাত্রনেতারা খেলে; নিজেদের চাঁদা আদায়, লবিং এবং সব অপকর্মের কর্মী সে। বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র শতকরা এক-দুই ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে। এখানে শিক্ষার্থী তার মেধা এবং যোগ্যতা নিয়ে ভর্তি হয়। ভর্তি হয়েই তাকে একটা সিটের জন্য জীবনের চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। এ রকম অবস্থায় টিকে থাকা দায়। বিশ্ববিদ্যালয় তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে না করায় মেধাবী জীবনগুলো প্রস্টম্ফুটিত হওয়ার বদলে ঝরে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আইন (অর্ডার, অর্ডিন্যান্স) এখানে অসহায়। প্রতি বছর মেধার ভিত্তিতে সিট দেওয়ার নিয়ম কেবল কেতাবেই আছে। কেতাবে এ রকম বহু জিনিসই আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী (বর্তমানে শিক্ষক) ২০০০ সালে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর প্রশাসনিক বিধিবিধানের পর্যালোচনা' নামে একটি একাডেমিক গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, হলের প্রশাসনিক বিধিবিধান 'অকার্যকরভাবে দুর্বল'। বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সের সাত নম্বর পরিচ্ছেদে আবাসিক হলগুলোর ৩৫টি নিয়মকানুনের প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রে ১১ বছর আগে তিনি বলেছেন 'অকার্যকরভাবে দুর্বল'। আর বর্তমানে কেউ গবেষণা করলে হয়তো তাকে 'অকার্যকর'ই বলতে হবে। তবে তিনি গবেষণার সিদ্ধান্তে বলেছেন, 'হলের বিধিবিধান প্রয়োগ করতে গিয়ে প্রশাসন কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়।'
প্রশাসন হলের বিধিবিধান প্রয়োগ করতে রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হবে কেন? প্রশ্নটা আসলে এখানেও, তাহলে এসব শিক্ষার্থীর জীবন নষ্টের জন্য দায়ী শুধুই কি প্রশাসন? যদি তা-ই না হয়, তাহলে হলগুলোতে প্রভোস্ট, হাউস টিউটর কিংবা অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগই-বা কেন দেবে? কারণ, কার্যত তো তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। না আছে সিট বণ্টনে, না হলের শৃঙ্খলা রক্ষায়? হল প্রভোস্টের কথা না হয় বাদই দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে আছে হাউস টিউটররা প্রতিদিন আবাসিক শিক্ষার্থীদের হাজিরা নেবেন। বাস্তবতা হলো, তারা প্রতিদিন হাজিরা নেবেন দূরে থাক, বছরে একদিনও পুরো হল ঘুরে দেখেন কি-না সে বিষয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাহলে তারা কী করছেন? উত্তরটা হলো, পুরো হল প্রশাসন যে দল ক্ষমতায় আসে সে দলের নেতাদের সহযোগিতার জন্য কাজ করছে। এসব নেতা যা বলে প্রশাসন তাই করে, পুরো প্রক্রিয়াটাই এখন উল্টো।

বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা একই রকম। আমরা বুয়েটের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন চিন্তা করতাম, সেটাও গত বছর কলঙ্কিত হলো। মেডিকেলও এর থেকে বাদ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবায়ের হত্যা, বুয়েটের শিক্ষার্থী বড় ভাইয়ের পা ভেঙে দেওয়া, জগন্নাথ-রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা কিংবা এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকর হত্যাসহ ক্যাম্পাসের সব হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা। জাহাঙ্গীরনগরে তো শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতির মেশালো চিত্র ভালোই দেখা গেল। বর্তমানে সিট পাওয়ার যে রাজনীতি চলে আসছে তা যদি চলতে থাকে এর ভয়ঙ্কর একটা ফল আমরা দেখব। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অনুরোধ, এই একটা বিষয় নিশ্চিত করুন। এর মাধ্যমে যেমন ছাত্র রাজনীতির নামে দলবাজি বন্ধ হবে, তেমনি হলের পরিবেশ ফিরে আসবে। এসLinkব বাদ দিলেও অন্তত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা নির্যাতন থেকে রেহাই পাবে। সিট বণ্টন প্রক্রিয়ায় কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নয়। এর আগে যেভাবে মেধার ভিত্তিতে প্রতি বছর সিট দেওয়া হতো সেটা চালু করা যায়। প্রয়োজনে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন হলে নতুন হল নির্মাণ করা যেতে পারে। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে। অনেকে নিশ্চয় ইতিমধ্যেই হলে সিটের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। তাদের জীবন হাসানের মতো যে নষ্ট হবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে!

সমকাল ২৮.০১.২০১২

ছবি কৃতজ্ঞতা- সমকাল, কালের কন্ঠ

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।