বিদ্যালয়গুলোতে এখন চলছে ভর্তির তোড়জোড়। ভর্তির ক্ষেত্রে অভিভাবকদের চিন্তার ধরনে কিছুটা হলেও একটা মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। ভর্তির প্রস্তুতির চেয়ে এখন ভাগ্যটাই মুখ্য। লটারির কথাই বলছি। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৩ নভেম্বর প্রকাশিত একটা খবর হলো, 'নিজের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি নয়।' আর ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর খবর_ 'বেসরকারি স্কুলেও প্রথম শ্রেণীতে লটারি বাধ্যতামূলক।' না, ভারতে বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি বাদ হচ্ছে না। সেখানে প্রথম আর পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তিতে লটারি হয়। যেসব বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল একসঙ্গে রয়েছে, সেখানকার প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদেরও পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তিতে লটারির কথা বলে বিদ্যালয়গুলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কেবল সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য সরকারের এই বিজ্ঞপ্তি।
ভারতে অনেক আগ থেকে যে লটারি রয়েছে, আমরা সেটা দেখলাম গত বছর। রাজধানীর সরকারি বিদ্যালয় এবং ভিকারুননিসাসহ কয়েকটা বেসরকারি বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য লটারি পদ্ধতি চালু হয়। সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে বলা চলে ভর্তির পদ্ধতি হিসেবে গত বছর থেকে চালু হওয়া লটারিটাই অঘোষিতভাবে নিয়ম। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়ে সে রকম কোনো নিয়ম নেই। যে যেভাবে পারছে ভর্তি নিচ্ছে। কেউ আগের মতো সেই পরীক্ষাই নিচ্ছে, অনেকে আবার সেখান থেকে বের হয়ে এসে লটারিকে বেছে নিয়েছে। তবে ১৬ ডিসেম্বরের সংবাদটার মাধ্যমে সবার জন্য লটারিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ আমরা ভর্তির ক্ষেত্রে সবার জন্য সরকারের তরফ থেকে আরোপিত একটা নীতিমালা দেখতে পেলাম। এখন থেকে সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যালয় প্রথম শ্রেণীতে লটারি পদ্ধতিতে ভর্তি করতে বাধ্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশিত চার পৃষ্ঠার নীতিমালাটা যে কেউ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে দেখতে পারেন।
দেরিতে হলেও একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা হয়েছে_ এটা বেশ ভালো খবর। কিন্তু এমন সময় এটা প্রকাশ হলো, যখন সব বিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পথে। স্বাভাবিকভাবেই ১৫ ডিসেম্বর বিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা প্রকাশ হলে বিদ্যালয়গুলো সেটা অনুসরণ করতে পারবে না; যেহেতু জানুয়ারির প্রথম থেকেই নতুন শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
নীতিমালার বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে, এখানে কী আছে তার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দেখি। বিদ্যালয়গুলো প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত আসন খালি থাকাসাপেক্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য কেবল লটারি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। দ্বিতীয় থেকে নবম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য লিখিত পরীক্ষা হবে। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির বয়স ৫-৭ বছর। ভর্তির ফরম একশ' টাকা। সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি এলাকাভেদে ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা শহরের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সন্তানদের জন্য কোটা থাকবে ২ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী কোটা রাখা হয়েছে ২ শতাংশ।
প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির ক্ষেত্রে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা সবাই দেখছি। ঢাকা শহরের অভিভাবকরা নামিদামি বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের ভর্তি করাতে বলা চলে আদাজল খেয়ে নামেন। যে শিশুটি বোঝে না পরীক্ষা কী, সারা বছর প্রাইভেট-কোচিংয়ে পড়িয়ে তার সামর্থ্যের বাইরে পড়াশোনা চাপিয়ে, তার ওপর যে নির্যাতন করা হয়, তা সত্যিই অমানবিক। কাঙ্ক্ষিত বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে অভিভাবকরা এতটাই মরিয়া যে, শিশুর বয়সের দিকে তাকানোর সময় নেই। বারবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এমনকি অন্য স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়লেও তাকে এনে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির নজির রয়েছে অহরহ। একবার না পারিলে দেখ শতবার যেন এখানেই বাস্তবে ফলে।
এ বছর হয়তো প্রশাসনের দেরিতে সিদ্ধান্তের কারণে সবাই এটা মানবে না। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেও সবাই যদি লটারি পদ্ধতি মানে, অন্য কিছু না হোক অন্তত অবুঝ বয়সের শিশুরা কিছুটা হলেও নির্যাতন থেকে রেহাই পাবে। এর মাধ্যমে কোচিং বন্ধকরণ, বয়সের সমতা আনয়নের কথা নাইবা বললাম। তবে যাদের সন্তানদের নামকরা স্কুলে না পড়ালে সামাজিক স্ট্যাটাস রক্ষা হয় না, যারা সন্তানদের ভর্তি করাতে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে পারেন, তাদের সন্তানরা লটারিতে না টিকলে খেসারত হিসেবে সন্তানটিকে মানসিক নির্যাতন ভোগ করতে হবে না_ এ নিশ্চয়তা কে দেবে? কিংবা তারা যে এখন টাকা দিয়ে হলেও সন্তানের ভর্তি নিশ্চিত করতে চাইবে, আর টাকার কাছে স্কুল প্রশাসন গলে যাবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? আর ক্ষমতাসীনদের চাপ ও তদবির বন্ধই-বা কে করবে!
আসলে লটারি পদ্ধতির কার্যকারিতা এখানেই। শতভাগ স্বচ্ছ না হলে এটি যেমন নির্ভরযোগ্যতা হারাবে, তেমনি হারাবে বিশ্বস্ততা। কার্যত এটার কোনো সুফল কেউ পাবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় এটা বেশ ভালোভাবেই এসেছে। এ ছাড়া ভর্তি ফির বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি অনেক স্কুল ভর্তির ক্ষেত্রে ইচ্ছামতো টাকা আদায় করে থাকে। অভিভাবক তার সন্তানকে ভর্তি করাতে বাধ্য। সুতরাং টাকা দিতেও বাধ্য। এবার সেটাকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে।
সরকারের এ নীতিমালা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের জন্য প্রযোজ্য কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বললে এসব স্কুলগুলো অন্তর্ভুক্ত হয় বটে। কিন্তু পুরো নীতিমালা পড়লেই বোঝা যাবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো ধরছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। জানুয়ারি-ডিসেম্বর শিক্ষাবর্ষ কিংবা ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা ইরেজি ও গণিতের যোগ্যতা যাচাই ঠিক তারই প্রমাণ।
গত বছর ভিকারুননিসা যখন লটারি চালু করল 'মেধার মূল্যায়ন হবে না' অভিযোগ করে কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে। তারা অবশ্য প্রধানত অভিভাবক। তবে এবার সরকারের নীতিমালা জারির পর এ রকম বিরোধিতা দেখা যায়নি। আসলে যার শিক্ষাজীবনই শুরু হয়নি তার আবার কিসের মূল্যায়ন। এছাড়া লটারি পদ্ধতি তো অনেক দেশেই প্রচলিত আছে। এমনকি রাজধানীর কয়েকটা ভালো স্কুলে আগেও এটা ছিল। যাদের পাবলিক পরীক্ষার ফল বেশ ভালোই হয়। সবাই লটারি পদ্ধতি একযোগে চালু করলে বরং সব স্কুলের মান সমান থাকবে। এখন যেমন স্কুলগুলোর পড়াশোনার মানে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তা কিছুটা হলেও কমবে এবং সবাই ভালো করবে।
প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির মাধ্যম যখন লটারি; ভাগ্যটা এখানে মুখ্য। কোমলমতি শিশুদের নির্যাতনের চেয়ে এটাই মন্দের ভালো। টাকাপয়সা, ক্ষমতা আর অনিয়মের কাছে এটা যেন পরাজিত না হয়। ভাগ্যই বিজয়ী হোক।
সমকালে প্রকাশিত ২৬.১২.২০১১