Mahfuzur Rahman Manik
নারীশিক্ষা কোন দিকে

যুগান্তরে ৭ জুন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ‘শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন, মানবৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখায় শিক্ষার ইতিবাচক বিষয়গুলো সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। তবে বাদ পড়েছে নারীশিক্ষার বিষয়টি। নারীশিক্ষায় সাম্প্র্রতিক ইতিবাচক পরিবর্তন এবং অগ্রগতি নিয়েই এ লেখার প্রয়াস।
এ পর্যন্ত চারটি আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়Ñ ১৯৭৫ সালে মেক্সিকো, ১৯৮০-এ কোপেনহেগেন, ১৯৮৫-এ নাইরোবি এবং ১৯৯৫-এ বেইজিংয়ে। সর্বশেষ ’৯৫-এর বেইজিংকে মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যাকে বলা হয় বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশন। দেখার বিষয় হল, বেইজিং সম্মেলনের পর কোন নারী সম্মেলন হয়নি, বরং পাঁচ বছর পর পর তার ফলোআপ পর্যালোচনা হয়েছে। বেইজিং কর্মপরিকল্পনার গুরুত্ব এখানেই। এটি ছিল নারীর এক শক্তিশালী দলিল। প্রতি পাঁচ বছর পরপর জাতিসংঘ যে পর্যালোচনা করে তার সঙ্গে + দিয়ে তার হিসাব করে। যেমন ২০০০’র পরের সময়কে বলে বেইজিং +৫, ২০০৫’র পরের সময়কে বলে বেইজিং +১০ আর ২০১০’র পরের সময়কে বলে বেইজিং +১৫।
বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশনের ১২টি ইস্যুর ভিত্তিতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মূল্যায়ন করা হয়। এগুলো হলÑ নারী ও দারিদ্র্য, নারীশিক্ষা, নারী ও স্বাস্থ্য, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, নারী ও অর্থনীতি, ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী।
এখানে যে ১২টি বিষয় রয়েছে, এর মধ্যে শিক্ষার বিষয়টি আমরা দেখব। বাংলাদেশে বেইজিং-পরবর্তী নারীর ১৫ বছরের অগ্রগতি নিয়ে মালেকা বেগম, সেলিনা হোসেন ও মাসুদুজ্জামানের সম্পাদনায় মাওলা ব্রাদার্স থেকে ‘বেইজিং কর্মপরিকল্পনা : নারীর অগ্রগতির পথরেখা’ নামে একটা বই প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের নারীর অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটেছে, যা শিক্ষামন্ত্রী তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। নারী শিক্ষায়ও এ উন্নয়ন কাক্সিক্ষত ধারায় এসেছে। প্রাথমিক স্তরে ছাত্রী ৫০.১ ভাগ, মাধ্যমিক স্তরে মেয়ে শিক্ষার্থী ৫২.৩ ভাগ। উচ্চমাধ্যমিকে এ হার ৪১.৬ শতাংশ, উচ্চশিক্ষায় ২৪ শতাংশ। এছাড়া পেশাগত শিক্ষা ৩৫.০ ভাগ এবং ভোকেশনাল শিক্ষায়ও ২৫.৯ ভাগ নারীর অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো। মাসুদুজ্জামান তার এক নিবন্ধে (যুগান্তর, ৪ জানুয়ারি ২০১১) এর পাশাপাশি পাবলিক পরীক্ষায় মেয়েরা যে ভালো করছে, সে বিষয়টিও এনেছেন।
বাংলাদেশে নারীশিক্ষার অগ্রগতি আমরা সাক্ষরতার হার দেখেও বুঝতে পারি। ১৯৭৪ সালে মেয়েদের সাক্ষরতার হার ছিল ১৪.৮ ভাগ, তা বেড়ে ১৯৯৯-তে এসে দাঁড়ায় ৫৮.২ ভাগে।
বাংলাদেশে নারীরা শিক্ষায় এগিয়েছে, এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। বেগম রোকেয়ার সময়ের কথা যদি ধরি, তার কাছে শিক্ষা অফিসার গ্রাজুয়েট মেয়েদের একটা তালিকা চেয়েছিল, তার উত্তরটা ছিলÑ ‘কিন্তু আমি বঙ্গের একটি গ্রাজুয়েট এবং আগা মঈদুল সাহেবের কন্যাত্রয় ব্যতীত আর কাহারো নাম দিতে পারি নাই।’
আজ বাংলাদেশে নারীরা যেমন শিক্ষায় এগিয়েছে, তেমনি ক্ষমতায়নের দিক থেকেও নারীর অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো। আর এর গোড়ার কারণটা কিন্তু শিক্ষা, অর্থাৎ যখনই নারী শিক্ষায় এগিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষমতায়নও হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি সেলিনা হোসেন তার (সমকালে ৭ মার্চ, ২০১০) প্রবন্ধে দেখিয়েছেন। তার ভাষায়, বাংলাদেশে নারী প্রথম ১৯৭৯ সালে সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেয়, ১৯৮৬-তে পাঁচজন, ১৯৯১-তে চারজন, ১৯৯৬-তে ১১ জন। আর সেটা বেড়ে ২০০৮-এ হয় ১৯ জন। আমরা দেখছি, ১৯৭৯ সালে সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ছিল ৩০। ২০০১ সালে বেড়ে হয় ৪৫।
বেগম রোকেয়া তার সময়ে তিন-চারজন নারী গ্রাজুয়েট খুঁজে পেতেই গলদঘর্ম হয়েছেন, এখন গ্রাজুয়েট তো বটেই, বিসিএসের ২৮টি ক্যাডারে নারী আছেন পাঁচ হাজারের ওপরে। অন্যান্য চকরিতেও নারীর সংখ্যাটা একেবারে ফেলনা নয়।
দেশে নারীশিক্ষার বৈপ্লবিক অগ্রগতির পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রী উপবৃত্তি। বিগত দেড় দশক ধরে সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ছাত্রীদের এ উপবৃত্তি দিচ্ছে। এ কারণেই প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এতদিন ধরে øাতক স্তরে ছাত্রী উপবৃত্তি ছিল না। বর্তমান সরকার সে পদক্ষেপও নিয়েছে। এই স্তরের ছাত্রীদের উপবৃত্তির জন্য প্রায় ৩৪৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাসের কথা আছে।
বাংলাদেশে নারীশিক্ষায় যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও নারী নির্যাতন এখনও বন্ধ হয়নি। নারীরা শিক্ষিত হলে সচেতন হবে, স্বাভাবিকভাবেই তখন নির্যাতন কম হওয়ার কথা ছিল। বাস্তবতা হল, অশিক্ষিত তো বটেই শিক্ষিতি নারীও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সাম্প্র্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকার স্বামী কর্তৃক নির্যাতন তার বড় প্রমাণ।
নারীশিক্ষার সঙ্গে সরাসরি দেশের উন্নতির বিষয়টি জড়িত। একজন শিক্ষিত নারী দেশের মানবসম্পদ। এছাড়া নারী তার গৃহকর্মে যে শ্রম দেয়, তাও আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। নেপোলিয়নের কথা ধরলে, শিক্ষিত নারীই একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে সক্ষম। সুতরাং নারী শিক্ষায় অগ্রগতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে নারী শিক্ষায় যে অগ্রগতি আছে, তা আরও বেশি হতে পারত। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারীরা এখনও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। একজন অভিভাবক তার মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করেন না। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট পরিবর্তন দরকার। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারের পরিকল্পনা মতে ৩০ ভাগ নারী থাকা দরকার। বেনবেইজের সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী নারী শিক্ষক আছেন ১৮ দশমিক ৭ ভাগ। নারী বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় যে কোন পেশায় আসতে চাইলেও পারছে না। পুরুষরাই তাদের জন্য বাধা হয়ে আছে।
বাংলাদেশে নারীশিক্ষায় অগ্রগতির বিপরীতে ঝরে পড়ার হতাশাজনক চিত্রও আছে। সর্বশেষ হিসাবে প্রাথমিক স্তরে প্রায় ৩৫ এবং মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৪২ শতাংশ ছাত্রী ঝরে পড়ছে। তবে আশার কথা হল, এবারের শিক্ষানীতিতে নারীশিক্ষায় অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছেÑ নারীর জন্য বিশেষ তহবিল গঠন, বৃত্তিমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা, উপবৃত্তি বাড়ানো ইত্যাদি।
পুরুষশাসিত সমাজে এখনও নারী নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও নারীশিক্ষার বর্তমান উন্নতি অব্যাহত থাকলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের মাধ্যমে আগামী দিনে নারী শিক্ষাসহ ক্ষমতায়ন এবং অন্যসব ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি লক্ষণীয় মাত্রায় বাড়বে সন্দেহ নেই।

যুগান্তর ২৮.০৬.২০১১

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।