Mahfuzur Rahman Manik
ডেলাইট সেভিং টাইম আমাদের ডিজিটাল দুর্ভোগ
মার্চ 17, 2010

১৯ জুন-২০০৯। সময় রাত ১০টা ৩০ মিনিট। সেল ফোনটি বেজে উঠে। কল নয়, মেসেজ এসেছে। একসঙ্গে কয়েকটি মেসেজ। শব্দের ভিন্নতা থাকলেও সব মেসেজের মূল ভাব অভিন্নÑ ‘চোখ রাখুন টিভির পর্দায়, একটু পরেই দেখবেন প্রধানমন্ত্রী কিভাবে দেশের ১২টা বাজান।’ না, প্রধানমন্ত্রী দেশের ১২টা বাজাননি, ঘড়ির কাঁটার ১২টা বাজিয়েছেন। অর্থাৎ রাত ১১টার কাঁটাকে করেছেন ১২টা। এক ঘণ্টা এগিয়ে দিয়েছেন সময়। সে ১৯ জুন থেকে আজও আমাদের ঘড়ি এক ঘণ্টা এগিয়ে। এ সময়টাকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বলে ‘ডে লাইট সেভিং টাইম’। বিশ্বব্যাপী এ ‘ডে লাইট সেভিং টাইম’ সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি রীতি। ২০০৯-এ এসে বাংলাদেশ এ রীতির অনুসরণ করছে। সূচনাটা অবশ্য অনেক আগের। এর ধারণা প্রথম দেন আমেরিকার বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন। ১৭৮৪ সালে তিনি ধারণা দেন। প্রথম ডে লাইট সেভিং টাইম আমেরিকার রেল রোডে প্রয়োগ করা হয়। অবশ্য তখন ঠিক এ নামে ছিল না। ১৯০৭ সালে এসে ব্রিটেনের একজন স্থপতি বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করেন। এ ব্যাপারে তিনি অহ বপড়হড়সরপধষ ঢ়ৎড়লবপঃ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। উইলিয়াম ওয়ালেট নামের এ স্থপতি তার প্রবন্ধে দিনের আলোকে ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। ফলে এটি ডে লাইট সেভিং টাইম হিসেবে পরিচিত। প্রথম দিকে আমেরিকা আর ব্রিটেন এ সময়ের অনুসরণ করে। এর পরই বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের অনুসরণে এ রীতি চালু করে। ১৯১৬ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে এ রীতি অনুসরণ করে। বর্তমানে ২০০৯ প্রায় ৭৫টি দেশে এটি চালু আছে। বাংলাদেশ যার অন্যতম। ডে লাইট সেভিং টাইম চালু করার পেছনে প্রধান কারণটি দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার হলেও সময়ভিত্তিক ওয়েবসাইট িি.িঃরসবধহফ ফবঃব.পড়স কয়েকটি কারণ বের করেছে, সেগুলো হলো প্রথমতÑ মানুষ এ রীতি পছন্দ করে, দ্বিতীয়ত এনার্জি সেভিং, তৃতীয়ত ট্রাফিক দুর্ঘটনা কমানো, অপরাধ কমানো, ভোটারদের আকৃষ্টকরণ- ইত্যাদি। বাংলাদেশ অবশ্য বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের বিষয়টি মাথায় রেখেই এ সময়ের প্রচলন করে। খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা যায় সরকার এ রীতির অনুসরণে ঘড়ির কাঁটাকে এক ঘণ্টা এগিয়ে এনেছে।
ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে আনতে সরকার দেশের জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তেমন কোনো আলোচনা করেনি। মিডিয়ায় সরকারের এ পরিকল্পনার সংবাদ পেয়েই অনেকেই এর পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সবারই যুক্তি ছিল। অবশ্য আমাদের জন্য দেখার বিষয়ও ছিল যে সরকার আসলেই কতটা বিদ্যুৎ সাশ্রয় করছে। বিষয়টি তখন বলা চলে সবাই মেনে নিয়েছে কারণ তখন সূর্য উঠত সোয়া পাঁচটায়, আর এক ঘণ্টা এগিয়ে আনার পর হলো সোয়া ছয়টা। ঘুম থেকে উঠে সূর্যকে মাথায় নিয়ে তখন অনেক কাজ করাই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা এখন। সমস্যা এখনও হতো না, যদি সরকার তার ওয়াদামতো কাজ করত। সরকার জুনে ডে লাইট সেভিং টাইম চালু করেছে, বলেছে সেপ্টেম্বরে কিংবা অক্টোবরে এসে আগের সময়ে ফিরে যাবে। সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর তো শেষ হলোই তারপর নভেম্বর পেরিয়ে এখন ডিসেম্বর। অবশ্য অক্টোবরে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীসহ প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তোফিক-ই-ইলাহী স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ঘড়ির কাঁটাকে আর পেছানো হচ্ছে না। অবাক হয়েছি আমরা। একদিকে ডে লাইট সেভিং টাইম-এর অনুসরণ করা হয়। এ জন্য একে সামার টাইমও বলে, অর্থাৎ সাধারণত গ্রীষ্মে বিশ্ববাসী এ সময়ের অনুসরণ করেন। প্রায় সব দেশেই যারা এর অনুসরণ করেন তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় দেয়া আছে। যেমন আমেরিকায় এর রুটিন হলো এপ্রিল মাসের প্রথম রোববার থেকে অক্টোবরের শেষ রোববার। মিশরে এপ্রিলের শেষ শুক্রবার থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ বৃহস্পতিবার। এভাবে প্রত্যেক দেশের আছে। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। যদিও এখনও সময় সংক্রান্ত ওয়েবসাইটগুলোতে অন্যান্য দেশের যেমন নির্দিষ্ট তারিখ ও সময় দেয়া আছে সেখানে বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে কারো মতে বাংলাদেশ মূল সময়ে ফিরে যাবে সেপ্টেম্বরে আবার কেউ বলে অক্টোবরে।
আমার কথা কিন্তু সেখানে নয়। বাংলাদেশ ডে লাইট সেভিং টাইম-এর বিশ্বের অন্যান্য উদাহরণ মানলো কি মানলো না, এর ইতিহাস ভঙ্গ করলো কি করলো না সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো এ সময়-রীতি আমাদের দেশের জন্য, জনগণের জন্য কতটা কল্যাণের সেটি। বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে এ সময় কল্যাণকর তো নয়ই বরং ক্ষতিকর বললেও কম হয়ে যায়। সরকার বিষয়টি কতটা লক্ষ্য করেছে জানি না, সরকারের এ সময়-রীতি বলা চলে শুধু শহরেই অনুসৃত হচ্ছে। সেটা এক প্রকার বাধ্য হয়েই। অথচ এর বাইরে গ্রামের যে বিশাল অংশ, অধিকাংশ মানুষ যে গ্রামে বাস করে সেখানে কেউই এ সময়ের অনুসরণ করে না। গ্রামের মানুষের কাছে আগের সময়ই সময়। নতুন সময়কে তারা চমৎকার একটি নাম দিয়েছে ‘ডিজিটাল টাইম’। যদিও জনগণের দেয়া এ ডিজিটাল টাইমই এখন সর্বত্র প্রসারিত। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছেন, ফলে সরকারের প্রণীত নতুন সময়ও ডিজিটাল নামেই সবাই জানে। আজকে এ ডিজিটাল টাইম শহরের ক্ষুদ্রাংশ অনুসরণ করেন তাদের কিন্তু দুর্ভোগের শেষ নেই। দুর্ভোগ যে শুধু তাদের তাও নয়। সরকারি সময় বলে গ্রামের জনগণ এ সময়েরও খোঁজ-খবর রাখত। গ্রামে ঈদের জামাতের মাইকিংয়েও বলা হয় ঈদের জামাত সকাল সাড়ে আটটায়, ডিজিটাল সাড়ে নয়টায়। তাদের একসঙ্গে দুটো সময়ই বলতে হয়। তাদের অনুসরণ করা সময়মতো রেডিও টিভি কিংবা অন্য কোনো চ্যানেলের সংবাদ পরিবেশন হয় না। গ্রাম থেকে কেউ শহরে আসলে কিংবা শহর থেকে কেউ গ্রামে আসলে হোঁচট খেতে হয়। এগুলো অবশ্য ছোট সমস্যা। বড় সমস্যায় আসছি। তার আগে বলছি সাধারণ মানুষসহ সর্বস্তরের মানুষ কিন্তু এ নতুন সময়কে সেভাবে মেনে নিতে পারেনি। জনমত আর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়কে সরকারকে অবশ্যই দেখতে হবে। আমরা যারা শহরে বাস করছি ডে লাইট সেভিং টাইমে প্রধান সমস্যা তাদেরই। এ সমস্যা প্রধানত যাদের বেশি পোহাতে হচ্ছে বা হবে তারা হলো নারী ও শিশু। যাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে রাষ্ট্র বা সরকার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নেবে। এ সময় সে সরকার দ্বারাই তাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে। এখন সূর্য উঠে ভোর সাড়ে সাতটায় কিংবা আটটায়, একটি শিশু কখন ঘুম থেকে উঠবে, নাস্তা করবে। কখন স্কুলে যাবে। এখন অবশ্য সাধারণ বিদ্যালয়গুলো বন্ধ কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল খোলা। আবার জানুয়ারিতে যখন সকল প্রতিষ্ঠান খুলবে তখন সূর্য উঠবে পোনে আটটায়। তখন একই সমস্যায় পড়বে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে শিশুটির মা কিংবা বাবা অনেক কষ্টে তাকে ঘুম থেকে উঠাচ্ছে। শিশুটি ঘুমে। নাস্তা করার সময় কোথায়? ঘুমের মধ্যে রেখে কোলে নিয়ে স্কুলে পৌঁছতে হয়। এটি শিশুদের জন্য কতটা খারাপ, কিংবা তাদের প্রতি কতটা অবিচার করা হচ্ছে তা একটি শিশুর ঘটনাই প্রমাণ করে। স্ট্যান্ডার্ড ফোর-এ পড়–য়া (ইংলিশ মিডিয়াম) ছাত্র ইশাত-এর কথা বলা যায়। একদিন ইশাতের পড়াকালীন সময়ে সামনে একটা শব্দ আসলো ঞুৎধহঃ, বললাম এর অর্থ পৎঁবষ ৎঁষবৎ (নির্দয় শাসক)। ইশাত বললো ঝরৎ, বি ধৎব ঁহফবৎ ংধসব ৎঁষবৎ (্আমরাও তেমন শাসকের অধীনে বাস করছি)। বললাম কেন? উত্তরটি ছিল, স্যার স্কুলের ক্লাস শুরু হয় সকল ৮টায়। ঘুম থেকে উঠতে হয় ছয়টায়। এত আগে কি ঘুম থেকে উঠা যায়। আবার সারাদিনও ঘুমের সুযোগ নেই। সরকার কি ঘড়ির কাঁটা পেছাতে পারে না, তাহলে সরকারকে আমরা কি বলবো। আমি কোনো জবাবই দিতে পারিনি।
নারী। ঢাকা শহরে গার্মেন্টস শ্রমিক বাস করে প্রায় ২০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী। অনেক গার্মেন্টসই ভোর আটটা থেকে কাজ শুরু করে। এ ক্ষেত্রে গার্মেন্টসে বা অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে যে সব নারীকে কাজ করতে আসতে হবে, তাদের দুর্ভোগ কতটা বেশি তা চিন্তা করলেই শিউরে উঠতে হয়। প্রথমত নারী মানে তার স্বামী আছে, সন্তান আছে, সংসার আছে। কাজে যখন তাকে যেতে হবে সবাইকে গুছিয়েই সে কাজে যাবে। কর্মক্ষেত্র গার্মেন্টস যদি দূরে কোথাও হয় আগেই তাকে রওনা দিতে হবে। অর্থাৎ পোনে আটটায় যেখানে সূর্য উঠবে সেখানে তাকে সাতটায়ই কর্মক্ষেত্রে রওনা দিতে হবে। তখন চারদিকে অন্ধকার, রিকশা নেই, চলাচলের কিছু নেই, সে মহিলাটি কিভাবে কর্মক্ষেত্রে যাবে। কিভাবে ম্যানেজ করবে তার গোটা পরিবার।
আমি জানি না সরকার বা কর্তা ব্যক্তিরা কি করছে। যে সরকার জনগণের কল্যাণে এসেছে, সে সরকার কিভাবে নাগরিক দুর্ভোগ সহ্য করবে। সরকার যে বিদ্যুতের দোহাই দিয়ে ডে লাইট সেভিং টাইম কার্যকর করেছে সে বিদ্যুতের বাস্তব কোনো উন্নতি আমরা দেখিনি। লোডশেডিং আগের মতোই। আসলে কতটা বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়েছে সেটি দেখার বিষয়। আর যতটা সাশ্রয় হচ্ছে তা নাগরিক দুর্ভোগের চেয়েও কতটা বড় বিষয় তা দেখা উচিত।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। মৌলিক নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের দেশ। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা এ পাঁচটি মৌলিক মানবাধিকার পাচ্ছে না সকল মানুষ। যাদের খাওয়ার ব্যবস্থাতেই জীবন শেষ। ডে লাইট সেভিং টাইম দিয়ে তারা কি করবে। সরকারের প্রাধান্য খাতগুলো দেখা উচিত। অযথা এ সময়ের বাস্তবায়ন কোনোই প্রয়োজন ছিল না। ২০০৭ সালে একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারও এ সময়কে এগিয়ে আনার চিন্তা করছিল, কিন্তু বাস্তবতা দেখে তারা অগ্রসর হয়নি। এ সরকার যেহেতু ঘোষণা দিয়েই কয়েকদিনের মধ্যে তা করে ফেলেছে। এখন সরকারের ভাবার সময় এসেছে। সরকার যদি সত্যিই ডে লাইট সেভিং টাইম চায়, সেটা বাস্তবতার আলোকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শীতে এক সময় আর গ্রীষ্মে একসময় নির্ধারণ করতে পারে। যেহেতু গ্রীষ্মে আমাদের দিন বড় থাকে গ্রীষ্মকালেই ডে লাইট সেভিং টাইম থাকবে। সেটার অবশ্য নির্দিষ্ট তারিখ থাকবে। এমন হতে পারে এপ্রিল হতে সেপ্টেম্বর। অথবা আদৌ আমাদের দেশে এ সময়ের কোনো প্রয়োজন আছে কি না সেটাও ভাবতে হবে। এখন অনেক দেশ এই ডে লাইট সেভিং টাইম হতে বের হয়ে গেছে। চীন বের হয়ে এখন তাদের দেশে ওয়ান টাইম জোন চালু করেছে। প্রতিবেশী ভারতও এটি অনুসরণ করে না। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেও আগে ছিল কিন্তু এখন নেই। এসবের মূল কথা হলো আমাদের আগের সময়ে ফিরে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত। বিশেষ করে এখন তো সেটা জরুরি হয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে ঘড়ির কাঁটা সরকারকে পেছানোই উচিত। কিন্তু সরকারের যা বক্তব্য তাতে বোঝা যাচ্ছে সরকার এ সময়ের পরিবর্তন করবে না, ঘড়ির কাঁটাকে পিছাবে না। তার কারণ আমরা জানি না। সরকার জনদুর্ভোগ কমাবে কি না, তার বিচার সরকারের হাতেই রইলো।

দৈনিক ডেসটিনি ২ ডিসেম্বর ২০০৯

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।