Mahfuzur Rahman Manik
ইসরায়েল যেভাবে পশ্চিমাদের বোকা বানাচ্ছে

গত বছরের ৭ অক্টোবর হামলার পর থেকে ইসরায়েলি সরকার ও এর প্রপাগান্ডা মেশিন পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে শুধু একবার-দুইবার নয়, বহুবার প্রতারণা করেছে এবং বোকা বানিয়েছে। প্রথমে বলেছিল, হামাস ৪০টি শিশুকে শিরশ্ছেদ করেছে, যদিও এমনটা কখনও ঘটেনি। এর পর শিশুদের চুলায় পোড়ানোর গুজবও ছিল মিথ্যা। আল-শিফা হাসপাতালের নিচে লুকানোর দাবিও সত্য ছিল না। গাজায় ফিলিস্তিনিরা জখমের ভুয়া ফটোসেশন করছে– এমন প্রচারণাও ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট। আল-রান্টিসি শিশু হাসপাতালের দেয়ালে হামাসের জিম্মিদের তালিকা থাকার দাবিও অসত্য। সেটি ছিল আরবি ক্যালেন্ডারে থাকা সপ্তাহ ও দিনের নাম। তবুও ইসরায়েলিরা মিথ্যা বলে চলেছে এবং আমাদের পশ্চিমা রাজনীতিক ও মিডিয়া অভিজাতরা বোকা বনে যাচ্ছে।

ইসরায়েলি মিথ্যাচারের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষতিকর, ধ্বংসাত্মক ও মারাত্মক বিষয় ইউএনআরডব্লিউএ তথা ফিলিস্তিন শরণার্থীদের সেবাদানকারী জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা নিয়ে মিথ্যাচার। ইসরায়েলের দাবি, হামাসের সঙ্গে ইউএনআরডব্লিউএর যোগসাজশ রয়েছে। এমনকি তারা আরও বাজে কথা বলে– ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলায় সংস্থাটির ১২ জন স্টাফ অংশ নিয়েছিল। এটি ডাহা মিথ্যাচার। এভাবে ইসরায়েল ও তাদের পশ্চিমা সহযোগীদের ইউএনআরডব্লিউএ-বিরোধী নিরলস প্রচারণার পরিণতিতে জানুয়ারির শেষ দিকে সংস্থাটির প্রধান অর্থ সাহায্যকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৬টি দাতা দেশ তাদের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল স্থগিত করে।

সেসব দেশকে সতর্ক করা হয়েছিল– গাজার বৃহত্তম ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএকে এভাবে অর্থ বন্ধের মাধ্যমে সেখানে ‘শিগগিরই দুর্ভিক্ষের’ ঝুঁকি তৈরি হবে। তাদের বলা হয়, এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ। কিন্তু তারা সত্যিকার অর্থেই ইসরায়েলকে বিশ্বাস করেছিল। তবে গত তিন মাস ধরে ফিলিস্তিনি শিশুরা যেহেতু আক্ষরিক অর্থেই অনাহারে মারা গেছে, সেসব দেশের অনেকেই বিলম্বে হলেও সংস্থাটিকে পুনরায় তহবিল দেওয়া শুরু করেছে। তাদের অন্যতম হলো জার্মানি। এ দেশটি সংস্থাটির দ্বিতীয় তহবিলদাতা।

তারা কেন পুনরায় তহবিল দিচ্ছে? কারণ গত সপ্তাহে সাবেক ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাথরিন কলোনার নেতৃত্বাধীন একটি দল ইউএনআরডব্লিউএতে তদন্ত চালিয়ে এই উপসংহারে পৌঁছেছে– ফিলিস্তিনিদের মানবিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সংস্থাটির ভূমিকা অনন্য এবং এর কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া ইসরায়েল সরকার তাদের দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।
এতৎসত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সংস্থাটিকে পুনরায় অর্থায়ন করতে অস্বীকার করেছে। বস্তুত কংগ্রেস ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সংস্থায় তহবিল নিষিদ্ধ করার আইনও পাস করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান রাজনীতিক ও পণ্ডিতদের কথা চিন্তা করুন, যারা ইউএনআরডব্লিউএ সম্পর্কে ইসরায়েলের মিথ্যাচারকে সমর্থন করছে এবং এর সপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজের কথা বলা যায়। যিনি জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ছয়বার ইউএনআরডব্লিউএ সম্পর্কে টুইটে দাবি করেছেন, সংস্থাটি ‘সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে’, ‘তারা হামাসের সঙ্গে আপস করেছে’ এবং ‘৭ অক্টোবরের সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ১২ কর্মচারী জড়িত ছিল’। জর্জ ডব্লিউ বুশের সাবেক বক্তৃতা লেখক ডেভিড ফ্রাম বলেছিলেন, ‘ইউএনআরডব্লিউএকে অনেক আগেই বাদ দেওয়ার দরকার ছিল’ এবং তিনি সংস্থাটিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠনকে উপকরণ দিয়ে সহায়তা প্রদান’-এর অভিযোগ করেছেন।

তাদের সবার দাবি ভুল; সবাই মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে; সবাই ইসরায়েলি প্রপাগান্ডায় তা দিচ্ছে। আরও দুঃখজনক, এর সঙ্গে শুধু রিপাবলিকান বা ডানপন্থিরাই নয়, বরং ডেমোক্র্যাট দলেরও অনেকে ইউএনআরডব্লিউএ সম্পর্কে নেতানিয়াহু সরকারের মিথ্যাচারকে অন্ধভাবে সমর্থন করে তার পক্ষে কথা বলছেন। যেমন টেড ক্রুজের মতো ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান জস গোথেইমারও জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ইউএনআরডব্লিউএকে আক্রমণ করে অর্ধ ডজন টুইট করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন– ‘স্পষ্ট প্রমাণ আছে: ইউএনআরডব্লিউএতে কর্মরতরা ৭ অক্টোবরের হামলায় হামাসকে সহায়তা দেয়।’ ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শেরম্যান বলেছেন, ইউএনআরডব্লিউএকে তহবিল না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাইডেন প্রশাসনকে ধন্যবাদ। তিনি সংস্থাটির ‘স্টাফদের সন্ত্রাসী হিসেবে’ ঘোষণা করেছেন। কংগ্রেসম্যান রিচি টরেস টুইট করেছেন, ইউএনআরডব্লিউএ ‘গাজা শাসন করছে এবং হামাসের নির্দেশনা পালন করছে’।

এমনকি গত সপ্তাহে এই বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন তদন্ত প্রকাশের পরও এই বিশিষ্ট ডেমোক্র্যাটদের কেউই তাদের টুইটারে এসব মিথ্যা দাবি প্রত্যাহার করেননি। শুধু তাই নয়, তারা সেই পর্যালোচনার ফলাফলও উল্লেখ করেননি। তবে সবচেয়ে খারাপ ছিল ২৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের বিবৃতি। তিনি স্বীকার করেছিলেন, এসব অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিজেদের তদন্ত করার ক্ষমতা ছিল না’। তারপরও ইসরায়েলের এসব অভিযোগ যাচাই না করেই সেগুলো ‘খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য’ বলে অভিহিত করেন।

এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, ৭ অক্টোবর ইউএনআরডব্লিউএর কর্মীদের অংশগ্রহণের দাবি প্রশ্নসাপেক্ষ। এর পরও ব্লিংকেন তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেননি। ভুল দাবি প্রত্যাহারও করেননি।
ইসরায়েল গাজার জনগণকে অনাহারে রেখেছে। সেই নির্বোধদের জন্য লজ্জা, যারা একে ন্যায্যতা দিতে সাহায্য করেছে।

সমকালে প্রকাশ: ৬ মে ২০২৪

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।