শিরোনামের প্রশ্নটি লেখকের মতো হয়তো অনেকেরই। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে যখন উঠে এসেছে, দেশের প্রায় ৪১ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের ব্যর্থতা সামনে আসছে। বাস্তবে শিক্ষকদের এ ব্যর্থতার পেছনে যে কিছু কারণ রয়েছে, যেগুলো সত্যিকার অর্থে শিক্ষকদের সৃজনশীল হতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা দেখার বিষয়।
বলা প্রয়োজন, গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষায় নতুন পদ্ধতি চালুর দাবি ছিল অনেক দিনের। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ঘাড়ে যখন কোচিং-নোট-গাইডের মতো ছায়া শিক্ষা চেপে বসছিল, তখন দেশের শিক্ষাবিদদের সহযোগিতায় সরকার চালু করে সৃজনশীল পদ্ধতি। এ পদ্ধতি চালু হওয়ার সময় প্রত্যাশা করা হয়েছিল, দেশ থেকে কোচিং-নোট-গাইড উচ্ছেদ হবে, মুখস্থবিদ্যার বাইরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সৃজনশীল হবে, শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন ঘটবে। যদিও ২০০৮ সালে চালু হওয়া সৃজনশীল পদ্ধতির আজকের বাস্তবতা সংশ্লিষ্টদের অজানা নয়। কোচিং-নোট-গাইডও সৃজনশীল (!) হয়ে দিব্যি চলছে। কাগজে-কলমে খোদ প্রশাসনের প্রতিবেদনেও তার দুরবস্থার চিত্র সংবাদমাধ্যমে এসেছে। মাউশির 'একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনে' কেবল প্রায় ৪১ শতাংশ বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র তৈরির যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠেনি। আরও নানা বিষয় সামনে এসেছে। এদের ২৩ শতাংশের বেশি বিদ্যালয় প্রশ্নপত্র তৈরি করে অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায়। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রায় ১৭ ভাগ বিদ্যালয় বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র কিনে এনে পরীক্ষা গ্রহণ করে। প্রতিবেদনটি ৬ হাজার ৫৯৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ওপর করা হলেও এটি যে দেশের ১৮ হাজার ৫৯৮ বিদ্যালয়কে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে, তা বলাই যায়।
সৃজনশীল নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপিল্গট এডুকেশন' (রেস)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আরও খারাপ চিত্র উঠে এসেছে_ ৫৫ শতাংশ শিক্ষক এখনও সৃজনশীল পদ্ধতি কার্যকরভাবে আয়ত্ত করতে পারেননি। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ শিক্ষকের অবস্থা খুবই নাজুক। আর ৪২ শতাংশ শিক্ষক অল্পস্বল্প বোঝেন। রেসের প্রতিবেদনে গাইড বইয়ের কথাও এসেছে। আশ্চর্যের বিষয়, এখনও ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী গাইডবইয়ের সাহায্য নেয়। আর ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে। আর কোচিং তো চলছেই। এ দুই প্রতিবেদনসহ এর আগের কোনো প্রতিবেদনই সে অর্থে ভালো খবর দিতে পারেনি।
সৃজনশীল পদ্ধতির আশানুরূপ সুফল না পাওয়ার পেছনে বারবার শিক্ষকদের কথা উঠে আসছে। অভিযোগ হচ্ছে, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি, হলেও তারা সেভাবে শেখেননি কিংবা এ জন্য যে মেধা দরকার, শিক্ষকদের তা নেই বা এর পেছনে শিক্ষকদের যে সময় দেওয়া দরকার তা তারা দেননি। একই সঙ্গে নিজেরা চেষ্টা না করে অনেকে তৈরিকৃত (রেডিমেড) নোট-গাইড অনুসরণ করছেন ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞরা এও বলতে পারেন, শিক্ষকরা নিজেরাই সেভাবে সৃজনশীল নয়।
এসব অভিযোগ নিঃসন্দেহে ঠিক আছে। কিন্তু এগুলো আসলে সমস্যার উপরের দিক। স্থায়ী সমাধানের জন্য সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে হবে। সেদিকে তাকালে কার্যত মনে হবে, শিক্ষকরা সৃজনশীল নয়_ বিষয়টা এ রকম না বরং অনেকক্ষেত্রে শিক্ষকদের সৃজনশীল হওয়ার পথই রুদ্ধ। আসলে যারা আজকে এ পর্যায়ে শিক্ষকতায় আসছেন তাদের অনেকেই অনন্যোপায় হয়ে এ পেশা গ্রহণ করছেন। যারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করছেন, তারা একে উপভোগ নাও করতে পারেন। যার শিক্ষকতার প্রতি দরদ নেই, নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার মানসিকতা নেই এবং কোনোরকম বেঁচেবর্তে থাকা যার লক্ষ্য তাকে কতটা সৃজনশীল করা যাবে! কিন্তু এখানেও কি ওই শিক্ষককে দোষ দেওয়া যাবে? সে যদি তার পারিশ্রমিকের কথা চিন্তা করেন তাহলে তার এ অবস্থা হতেই পারে। ফলে একদিকে আমরা দেখছি কম পারিশ্রমিক পাওয়ার কারণে তিনি মূল পাঠদানে মনোযোগী হচ্ছেন না। অনেকে ঝুঁকছেন কোচিং, টিউশনি কিংবা অন্য কোনো আয়বর্ধনমূলক কাজে। অন্যদিকে এও দেখা যায়, বছরের নানা সময়ে শিক্ষকরা তাদের দাবি আদায়ে মাঠে থাকছেন দীর্ঘ সময় ধরে। এখানেও সেই পারিশ্রমিকই মুখ্য। অনেক সময় প্রশাসন সহজে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে চায় না, তখন তাদের মাঠে আন্দোলন করা ছাড়া উপায় থাকে না। এ অবস্থায় তাদের সৃজনশীল নিয়ে আলাদা সময় বের করার ফুরসত কোথায়?
আবার কেউ হয়তো সত্যিকারার্থেই সৃজনশীল পদ্ধতির সব বিষয় বুঝে উঠতে নাও পারেন। তারাও হয়তো এর জন্য যে চেষ্টা করবেন তা করতে চাচ্ছেন না। এর পেছনেও হয়তো সুযোগ-সুবিধা। সব মিলিয়ে শিক্ষকদের সৃজনশীল হওয়ার পথ অবারিত নয়। এ জন্য সর্বাগ্রে শিক্ষকদের বেতন-কাঠোমো, সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক প্রণোদনার দিকে তাকাতে হবে। অনেক সময় শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হন। যেমন এবার অষ্টম জাতীয় পে স্কেলে সবার বেতন হলেও এখনও এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা পাননি। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশিত হলে হয়তো বিদ্যমান শিক্ষকরা যেমন এখানে সময় দিতে আগ্রহী হবেন, তেমনি মেধাবীরাও এ পেশায় আসবেন। একই সঙ্গে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি সহজে মেনে নিলে তাদের মাঠে-ময়দানে আন্দোলনে সময় ব্যয় করতে হবে না; পাঠদানে তারা মনোযোগী হবেন।
এটা অবশ্য ঠিক, শিক্ষকতা যে মহান পেশা সে ব্রত নিয়ে অনেকে এখানে আসছেন। সময়-শ্রম দিয়ে ভালোও করছেন। অনেকে হয়তো অরুচি নিয়ে এসেও শিক্ষকতা ভালোভাবে করছেন। প্রশিক্ষণ কাজে লাগাচ্ছেন। তথ্যানুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরে ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ৫ লাখ শিক্ষককে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অন্তত ৬০ শতাংশ শিক্ষক যে সে অনুযায়ী কাজ করছেন তা মাউশির প্রতিবেদন থেকেও বোঝা যায়।
আমাদের প্রত্যাশা, সব শিক্ষক সমানভাবে সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করুক। কেবল সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরিই নয় বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে মনোযোগী হোক। এ জন্য তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। প্রত্যেকে ন্যায্য পারিশ্রমিক পেলে পঠন-পাঠনে মনোযোগী হবে। শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো হওয়ার আশ্বাস অনেক দিনের। এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে আরও উদার হওয়া প্রয়োজন। তাহলেই হয়তো ধীরে ধীরে শিক্ষার সংকট কাটবে, মান উন্নত হবে।