বিসিএসে তিনটি ধাপের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হওয়া কতটা কঠিন ও সাধনার বিষয়, তা প্রার্থী বাদে অন্য কারও পক্ষে যথাযথ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। প্রথম ধাপের প্রিলিমিনারির ধাঁধাই অধিকাংশ প্রার্থী পেরোতে পারেন না। সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসে প্রায় তিন লাখ আবেদনকারীর মধ্যে প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন মাত্র ২১ হাজারের কিছু বেশি প্রার্থী। এর পর লিখিত পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলে আসবে মৌখিক পরীক্ষার পালা। মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের গেজেটেড হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। এর পর আসে রাষ্ট্রীয় কর্মে যোগ দেওয়ার সুযোগ। তবে এ ধাপেও চলে আরেক দফা যাচাই-বাছাই; মূলত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। ফলে কয়েক বছর লেগে থেকে মৌখিক পরীক্ষা উতরানোর পরও বাদ পড়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
একজন বিসিএস প্রার্থীর জন্য চূড়ান্ত হতাশা ও অপমানজনক এই বাদ পড়ার ঘটনা অতীতেও দেখা গেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ৪৩তম বিসিএসেও তা ঘটল; বাদ পড়েছেন দুই শতাধিক প্রার্থী!
বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিছক রাজনৈতিক বিবেচনায় বিসিএস থেকে বাদ দেওয়ার সংস্কৃতি চরম রূপ নিয়েছিল। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারও বিস্ময়করভাবে এমন ধারাবাহিকতা বজায় রাখল। তবে স্বস্তির বিষয়, অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার পদক্ষেপ নিতে রাজি হয়েছে। বাদ পড়া প্রার্থীরা নিশ্চয় আবেদন করবেন। তবে সরকারের উচিত হবে সবাইকে নিয়োগ দেওয়া। এ বিষয়ে সাংবাদিক সোহরাব হাসান লিখেছেন– বিসিএস চাকরিপ্রার্থীরা দয়া নয়, ন্যায়বিচার চান (প্রথম আলো, ৪ জানুয়ারি, ২০২৫)। নিয়োগ পেলেই তারা ন্যায়বিচার পাবেন।
প্রশ্ন হলো, এসব প্রার্থী কেন বাদ পড়েছেন? প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, যখনই এ ধরনের অন্যায্য ও অন্যায়ের ঘটনা ঘটে, তখনই গুজব ডালপালা মেলার সুযোগ পায়। ইতোমধ্যে ভারতীয় কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়, বাংলাদেশে বিসিএসে বাদ পড়া অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যদিও বাস্তবে বাদ পড়াদের উল্লেখযোগ্য অংশ সংখ্যালঘু হলেও তারা অধিকাংশ নয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বাদ পড়া প্রার্থীদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অবস্থান তুলে ধরে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে; সেখানে কারণ হিসেবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। গোয়েন্দারা কী বিবেচনা করেছেন? চাকরির ভিত্তি হবে মেধা। প্রার্থীরা বাংলাদেশের নাগরিক হলে আর কিছু বিবেচনায় আসার কথা নয়। চাকরিতে কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন সরকার পতন পর্যন্ত গেল, তার শিক্ষা হলো– মেধাই হবে সরকারি চাকরির প্রধান যোগ্যতা। যে প্রার্থী তিনটি ধাপ উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁর মেধা যাচাই হয়েছে; এবার নিয়োগের পালা। ঠিক এ সময়ে ‘ভেরিফিকেশন’-এর নামে গোয়েন্দা বিবেচনায় বাদ দেওয়া অন্যায়।
এটা জানা যে, সাধারণত গোয়েন্দা রিপোর্টে প্রার্থীর রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়। এ নিয়ে শনিবার (৪ জানুয়ারি) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলমের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন– ‘চাকরিপ্রার্থী যদি নিজ যোগ্যতায় প্রিলিমিনারি, রিটেন, ভাইভা পাস করে সুপারিশপ্রাপ্ত হন এবং তাঁর যদি পূর্বে কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকে তাহলে তাঁর বাবা, চাচা, মামা, নানার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তাঁকে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হবে কেন?’ সারজিস আরও গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন– এবার নাকি ‘গোয়েন্দা সংস্থার অনেকে গিয়ে ইউনিয়ন আর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সেক্রেটারির কাছে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত চাকরিপ্রার্থীদের পরিবারের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা জানতে চেয়েছেন!’
সারজিসের বক্তব্য অনুযায়ী এবার যদি বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়ে থাকে, তবে এর পূর্বে স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হতো। ফলে ওই সময়েও প্রার্থী বাদ পড়তেন। এর আগে ৪১তম বিসিএসের গেজেট থেকে ৬৭ জনসহ আগের বেশ কয়েকটি বিসিএস থেকেও উল্লেখযোগ্য প্রার্থী বাদ পড়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এ ধরনের ভেরিফিকেশনের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা? ভেরিফিকেশনে কেবল দেখতে হবে কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আছে কিনা, জেল খেটেছেন কিনা কিংবা ভয়ংকর সন্ত্রাসী হলে তার রেকর্ড নিশ্চয় পুলিশের বইয়ে উল্লেখ থাকার কথা। এর বাইরে রাজনৈতিক বিবেচনায় আটকানোর ভেরিফিকেশন বন্ধ হওয়া দরকার। না হলে তার অপব্যবহার চলতেই থাকবে।
বছরের প্রথম দিন বিবিসি বাংলা অনলাইন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে– ‘বিসিএস স্বপ্ন’ পূরণ হয়েও হলো না… কেন বাদ পড়েছেন–- জানে না কেউ। সেখানে বাদ পড়াদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এমনকি অনেকে কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে কখনোই জড়িত ছিলেন না। এর মধ্যে একজন বুয়েট গ্র্যাজুয়েটও আছেন, যিনি বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় ২০তম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ১০ম হয়েছিলেন। বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি সেবার জন্য দেশেই থেকে যান।
২০২০ সালের নভেম্বরে ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি থেকে প্রার্থীরা যে স্বপ্ন দেখে আসছিলেন, কয়েক বছরের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যখন তাদের স্বপ্ন পূরণের পালা, তখন এ ধরনের অন্যায্য সিদ্ধান্ত কেন?
এই বিসিএসে বাদ পড়ারা বছরের প্রথম দিন সচিবালয়ে গিয়ে তাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন। রোববারও তারা একই দাবিতে সচিবালয়ে গেছেন। একই দিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বৈঠক ডেকেছে। নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা, তাদের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হোক। আওয়ামী লীগ আমলের বঞ্চিতদের নিয়োগ দিয়ে এ সরকার যেমন যথার্থ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তেমনি এ ক্ষেত্রেও সুবিবেচনার পরিচয় প্রত্যাশিত।