
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম মাসে দ্রব্যমূল্য কমার ইঙ্গিত দেখে লিখেছিলাম- মূল্যস্ফীতির ইতিবাচক ধারা। (সমকাল, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে তখন দেখানো হয় যে, জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি যা ছিল, আগস্টে তা এক শতাংশের বেশি কমে হয় ১০.৪৯ শতাংশ। এ চিত্র অনেককেই আশাবাদী করেছিল, আমিও আরও কমার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে মূল্যস্ফীতি কমেনি, উল্টো বেড়েছে। এতটাই বেড়েছে যে, রোববার প্রকাশিত ভয়েস অব আমেরিকার জরিপ বলছে, ৪৪.৭% মানুষ মনে করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার ‘আগের সরকারের তুলনায় খারাপ করছে’।
দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণে সরকারের অর্থ উপদেষ্টা কিছুটা সময় চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অবশ্য ৫-৬ মাসের কথা বলেছেন। ইতোমধ্যে সাড়ে তিন মাসের বেশি সময় শেষ হলেও তাদের উভয়ের প্রতিশ্রুতির কার্যকারিতা বাজারে তেমন স্পষ্ট নয়। অথচ এ সরকারের অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, এমনকি খোদ প্রধান উপদেষ্টাও অর্থনীতিবিদ, বাজারের গতিশীলতা বিষয়ে তাদের ভালো জানার কথা এবং সে কারণেই হয়তো অনেকের প্রত্যাশা বেশি ছিল।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে দেশের অধিকাংশ মানুষের স্বার্থ জড়িত। সে জন্য মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকারে থাকতেই হবে। অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য এজন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো কেন কাজে লাগেনি? জরিপে মানুষ যখন বলছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার ‘আগের সরকারের তুলনায় খারাপ করছে’, তা ভালো বার্তা দিচ্ছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যে হিসাব প্রকাশ করেছে, সে অনুযায়ী অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতির হার কমাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাজার নিয়ন্ত্রণের সাধারণ নীতি চাহিদার আলোকে সরবরাহ নিশ্চিত করা। এই সরবরাহের ক্ষেত্রে সংকট স্পষ্ট। বিশেষ করে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে কোনো পণ্য পৌঁছাতে বারবার হাতবদল হয়ে দাম বেড়ে যায়। পণ্য সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থায় চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের কারণেও মূল্যস্ফীতি ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যেমন ট্রাফিক শৃঙ্খলার দায়িত্ব নিয়েছিল, একইভাবে তারা অনেক জায়গায় বাজারও তদারক করেছিল। ওই সময় হাটে-ঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়ার কারণেও বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। পরে অবশ্য সেই চাঁদাবাজি ফিরে আসে। যে কারণে পণ্যের দাম কাঙ্ক্ষিত আকারে কমেনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমে হাত দিয়েছে। দেশের জন্য সেগুলো নিঃসন্দেহে জরুরি। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের জন্য বাজার স্থিতিশীল রাখাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা দেখছি, দীর্ঘ সময় ধরে দেশের চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আছে। কোনো পদক্ষেপেই যেন চালের দাম কমছে না। মাছ, মুরগি, আলুর দামও নিয়ন্ত্রণে নেই।
আগত রমজানে সাধারণ মানুষ যাতে স্বস্তিতে রোজা রাখতে পারে সেজন্য বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার এরই মধ্যে আট দফা পদক্ষেপ নিয়েছে। যেখানে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, কমিশন বন্ধের বিষযও এসেছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে কেবল এসব নির্দেশনা দিলেই হবে না; বাস্তবায়নের পদক্ষেপ জরুরি। দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে মানুষ এখন যে মত দিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সেখানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসার ব্যাপারে সরকারকে সচেষ্ট হতেই হবে।