Mahfuzur Rahman Manik
ক্যাম্পাসে নির্যাতিত ছাত্রীদের জবানবন্দি
নভেম্বর 20, 2024
যেভাবে মেয়েটির চারটি দাঁত ভেঙে দেওয়া হয়েছে; শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পোড়া ক্ষত আছে এবং সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় ইনফেকশন হয়ে গেছে; তার সুস্থ হতে কয়েক মাস লাগবে। ইতোমধ্যে নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি যথার্থই বলেছেন, কিশোরী গৃহকর্মীকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে; একজন সুস্থ মানুষ এভাবে নির্যাতন করতে পারে না।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নারী, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। নারীরা এ আন্দোলনে যেভাবে শিকল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, তার মাধ্যমে যেমন আন্দোলনে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ বাড়ে, তেমনি বিগত সরকারের পতনও ত্বরান্বিত হয়। তবে সেই ছাত্রীদের জন্য আন্দোলন এতটা সহজ ছিল না। কারণ, ছাত্রদের পাশাপাশি তারাও নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হন। এসব উপেক্ষা করে কীভাবে তারা রাজপথে এসেছিলেন, সে কথাই ফুটে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগ্রামী সিনথিয়া মেহরিন সকালের জবানবন্দিতে।

তিনি বলেন, ‘‘১৪ জুলাই যখন আমাদের উদ্দেশ করে ‘রাজাকার’ বলা হয়, তখন সেটি স্বাভাবিকভাবেই আমরা মেনে নিতে পারিনি। আমরা রোকেয়া হলের মেয়েরা রাত সাড়ে ১০টার দিকে হলের তালা ভেঙে বের হয়ে আসি। আমরা সবাই রাজু ভাস্কর্যের কাছে অবস্থান করি। একযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের ছেলেমেয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন।” শিক্ষা অধিকার সংসদের উদ্যোগে গত ২৬ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার আর্টস অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘ক্যাম্পাসে নির্যাতিত ছাত্রীদের জবানবন্দি ও বৈষম্যহীন শিক্ষাঙ্গন গড়ার দায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন সিনথিয়া মেহরিন সকাল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা অধিকার সংসদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ।

সিনথিয়া মেহরিন সকাল স্মৃতিচারণ করেন, ‘১৫ জুলাই আমরা প্রতিবাদ মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নিই। ওই দিন ছাত্রলীগেরও প্রোগ্রাম ছিল। ভিসি চত্বর পর্যন্ত আসতেই দেখি ছাত্রলীগের লোকজন আমাদের মারতে আসতে শুরু করে। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি এবং একটা সময় সংঘর্ষ বেধে যায়। আমার মাথায় রড দিয়ে আঘাত করা হয়। আমার কানে বিকট একটা সাউন্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যাই। তখন ভাবছিলাম, আমি হয়তো মারা যাচ্ছি। পরে কেউ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মাথা ফেটে যাওয়ায় ১০টি সেলাই দিতে হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েও আন্দোলনকারী কিনা, সে প্রশ্ন বারবার শুনতে হয়েছে। এমনকি পরিবারের সদস্যরাও হেনস্তার শিকার হয়েছেন।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিনা অপরাধে এক বছর জেল খেটেছেন। আদালত বারবার খাদিজার জামিন আবেদন নাকচ করে আসছিলেন। তিনি বলেন, ‘বিনা দোষে জেল খাটার পরও আমার পক্ষে বিভাগের থেকে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। কয়েকজন শিক্ষকের পক্ষ থেকে যে আচরণ পেয়েছি, তা ছিল সবচেয়ে বেদনাদায়ক। ভাইভা বোর্ডে যেভাবে প্রশ্ন করে হেনস্তা করা হয়েছে, সেটি আমাকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করেছে। নির্দোষ হয়েও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করার জন্য নিজেকে দোষী স্বীকার করে আসতে হয়েছে। কিছু কিছু শিক্ষকের আচরণ আমাকে প্রচণ্ড কাঁদিয়েছে। এমনকি আমাকে পরীক্ষায় নম্বরও কমিয়ে দেওয়া হয়।’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতনের ঘটনায় তোলপাড় হয় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে না চাইলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন ফুলপরী। পরীক্ষা থাকায় তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে অনলাইনে যুক্ত হয়ে জবানবন্দি দেন। তিনি বলেন, ‘নবীন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা মাত্র ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম, তখনই আমার সঙ্গে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। আমি হলে এসে আমাদের এলাকা পাবনার এক আপুর বেডে উঠি। কিন্তু নবীন শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে র‌্যাগ দেওয়া হচ্ছিল খুব করে। আমার ডিপার্টমেন্টে যারা ছাত্রলীগের অনুসারী ছিল, তারা খুব খারাপ ব্যবহার করছিল। এক রাতে আমাকে নেত্রীর রুমে যেতে বলা হয়। সেখানে সবাইকে একে একে পরিচয় দিতে বলা হয়। তারপর এমনিতেই খারাপ ব্যবহার শুরু করল। আমি তখন বললাম, আপনি আমার ডিপার্টমেন্টের আপু, এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছেন কেন? এটাই আমার দোষ হয়ে যায়। বলে, তোকে এখনই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছি হল থেকে। রাত ৮টার পর থেকে ১টা পর্যন্ত ভয়াবহ মানসিক নির্যাতন চালাল। স্যারদের কাছে প্রতিকারের জন্য গেলে উল্টো আমার মুচলেকা লিখে নির্যাতনকারীর সঙ্গে কোলাকুলি করিয়ে দিলেন। অথচ এরপর আমার ওপর রাতভর তারা নির্যাতন করে। একপর্যায়ে তারা আমার কাছ থেকে সুইসাইড নোট লিখে নিয়ে বলে, এবার তোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখব।’ ফুলপরী বলেন, ‘কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি রাজনৈতিক দলের হাতে জিম্মি না থাকে, তাহলে সকল শিক্ষার্থীর জন্যই নিরাপদ ক্যাম্পাস তৈরি হবে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কাজী ফারজানা মিম তাঁর বিভাগের শিক্ষক দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে একাই লড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে যৌন হয়রানির শিকার হই। কিন্তু অভিযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সাহস আমি দেখিয়েছি। আমাকে বলা হয়, এ ধরনের অভিযোগ করলে একাডেমিক ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যায়। তারপরও আমি অভিযোগ দিই। পরীক্ষায় আমাকে ফেল করানো হয় এবং আমি পুনরায় প্রতিবাদ করি ও নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। চার বছরের স্নাতক (সম্মান) কোর্স আট বছরে শেষ করতে হয়েছে।’

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আরেক সংগ্রামী ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী জয়মা মুনমুন। তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছর ছাত্রলীগ হলগুলোতে দখলদারিত্ব চালিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করানো হতো। না গেলে মানসিক-শারীরিক নির্যাতন, জোরপূর্বক অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করানো, ক্যান্টিনে চাঁদাবাজিসহ নানা রকম অপরাধমূলক কাজ তারা করে থাকত। ১৫ জুলাই ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। তখন ছাত্রলীগের নেত্রীরা তাদের ওপর হামলা করেন। শিক্ষকদের কেউ কেউ এ সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন।’

মুনমুন আরও বলেন, ‘এবারের আন্দোলনে নারীরা সামনে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু আন্দোলনের পর নারীরা এখন অনেকটা অদৃশ্য। কেন এমন হচ্ছে, তা জানা দরকার। এত আলাপ-আলোচনা হয়, কিন্তু নারীরা বাদ পড়ে যাচ্ছেন। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মেয়েদের কতটা মূল্যায়ন হচ্ছে, সে বিষয়টি ভাবা দরকার।’

সমকালে প্রকাশ: ৩ নভেম্বর ২০২৪

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।