Mahfuzur Rahman Manik
কেবল চাকরির বয়স নয়, তারুণ্য নিয়েও ভাবুন
অক্টোবর 11, 2024

কর্মসংস্থান

দেশের তারুণ্য নিয়ে অনেকের মধ্যে যে হতাশা ছিল; ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান অন্তত সেখানে ভিন্নভাবে ভাবার পথ খুলে দিয়েছে। তরুণরা যে দুর্দমনীয় এবং তারা চাইলে যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে ভূমিকা রাখতে পারে– তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। তারুণ্য জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ তারুণ্যের পুরো সদ্ব্যবহার আমরা এখনও করতে পারিনি। এমনকি তরুণদের বোঝাতেও পারিনি– তার সময় কতটা মূল্যবান। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পরও কারও কারও চাকরির প্রস্তুতিতে আরও চার-পাঁচ বছর চলে যায়।
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়লে হয়তো কেউ কেউ ওই পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবেন; কিন্তু ইতোমধ্যে জীবনের যে গুরুত্বপূর্ণ সময় চলে যাচ্ছে, তা আমরা কতটা ভাবছি?

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একটি জাতীয় দৈনিকের খবর মতে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন-২০২২ বলছে, দেশে বর্তমানে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ১৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশের কিছু বেশি। এই তরুণদের ৪০ দশমিক ৬৭ শতাংশ নিষ্ক্রিয় বলছে স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, যারা সংখ্যায় প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ। এই তরুণরা কাজ কিংবা শিক্ষায় কোথাও নেই! পরিসংখ্যানকে শতভাগ বিশ্বাস করা কঠিন বটে। কিন্তু তারুণ্যের অপচয় সম্পর্কে একটা ধারণা যে এর মাধ্যমে আমরা পাচ্ছি, সেটি তাৎপর্যপূর্ণ।
তারুণ্য নিয়ে ভাবার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়দের নিয়ে ভাবা যেমন জরুরি, তেমনি সক্রিয় তরুণরাও কতটা উৎপাদনশীল (প্রডাক্টিভ) কাজে যুক্ত, তাও বিবেচনায় নিতে হবে।
সরকারি চাকরির প্রসঙ্গে আসি। এ চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছে দেশের তরুণদের একটি অংশ। অথচ সরকারি চাকরিতে কর্মসংস্থানের হার মাত্র ৩ শতাংশ। তার পরও এ চাকরিতে প্রবেশে বয়স বাড়ানোর আন্দোলন নতুন করে গতি পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারও যে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে, তা পর্যালোচনা কমিটি গঠন থেকেই স্পষ্ট। এ ব্যাপারে কমিটি হয়তো শিগগিরই তাদের মতামত দেবে। অবশ্য ইতোমধ্যে দু-তিন বছর বাড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ালে সঙ্গে সঙ্গে অবসরের বয়স বৃদ্ধির বিষয়ও আসবে। তখন অন্তত আন্দোলনকারীদের ভাষ্য অনুযায়ী, নতুন এক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

সরকারি চাকরির পদ ও সুযোগ সীমিত হলেও সেটা ধরেই তরুণদের বড় অংশ যেভাবে ক্যারিয়ার পরিকল্পনা সাজায়; সমস্যা সেখানেই। অবশ্য তারা কেন এর বাইরে ভাবতে পারছে না, তার পেছনে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণগুলোও স্পষ্ট। এমনকি সংবাদমাধ্যমের মাতামাতিও সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক। বিগত কয়েক বছরে বিসিএস নিয়ে একটা ‘হাইপ’ আমরা দেখেছি। এর বাইরের কর্মসংস্থানে আমরা কতটা জোর দিয়েছি? বিসিএস কিংবা সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানে সুযোগ সীমিত বিধায় তারুণ্যের সফলতার গল্পের চেয়ে ব্যর্থতার পরিসংখ্যানই বেশি আসবে। সমাজে সেটাকেই গ্লোরিফাই করার ফলে তরুণরা যখন এদিকে ঝুঁকছে, তখন এক অন্তহীন অনিশ্চয়তা তাদের সামনে আসে। কারও মুখে হাসি ফোটে, কেউ দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও বেদনার ক্ষত নিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানে যেতে বাধ্য হয়।
বিসিএস প্রিলিমিনারির জন্য ৪ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিলেও শেষ পর্যন্ত ক্যাডার হয় দু-তিন হাজার। নন-ক্যাডার মিলে হয়তো আরও কয়েক হাজারের কর্মসংস্থান হতে পারে। বাকিদের সুযোগ দেওয়া বাস্তব কারণেই সম্ভব নয়। এ সীমাবদ্ধতার কারণেই সরকারি চাকরির পাশাপাশি বিকল্প সব কর্মসংস্থানবিষয়ক আলোচনা জরুরি।

শিক্ষা ও দক্ষতার প্রশ্নটি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন আজ শিক্ষিত বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে? শিক্ষার সঙ্গে শিল্পের যোগাযোগ কতটা? কেন শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহী হচ্ছে না? ১২-১৪ বছর ইংরেজি পড়েও কেন তরুণরা যোগাযোগে তা ব্যবহার করতে পারছে না? পঞ্চম কিংবা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরও কেন আমাদের মৌলিক জীবন দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না? দেশে এত শিক্ষিত বেকার থাকা সত্ত্বেও কেন বিদেশ থেকে হাজার হাজার কর্মী এসে দেশে কাজ করছে? এসব প্রশ্নের আলোকে শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর বিষয়টি ভাবতেই হবে।
তরুণদের যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরির পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ উন্মোচন করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। সরকারি চাকরির বাইরে গিয়েও অনেক তরুণ নিজ প্রচেষ্টায় কেবল নিজের ভাগ্যই বদলাননি, আরও অনেকের কর্মসংস্থানে সৃষ্টির সফলতারও উদাহরণ হয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে দেশে এবং বিদেশে উভয় ক্ষেত্রেই কাজের ক্ষেত্রে তৈরির সুযোগ আছে। বিদেশি দক্ষ কর্মী পাঠানোর বিষয়টি যেমন জরুরি, তেমনি দেশে থেকেই বিদেশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের বড় বাজার যে ধরা যায়, তার সঙ্গে তরুণদের সংযোগ করানো এবং সেভাবে তাদের দক্ষতা গড়ার বিষয়ও নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।
তরুণদের সফলতার গল্প কম নয়; কিন্তু সব তরুণকে কাজে লাগানোর যে জরুরত রয়েছে, তা অনুধাবন করা চাই। সম্প্রতি নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, সেখানে শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সংস্কারের বিষয়টি অস্বীকারের উপায় নেই। এই সংস্কারের সূচনা হওয়া উচিত মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে। শিক্ষিত তরুণরা কেন কেবল চাকরিকেই নিজেদের কর্মসংস্থানের উপায় ভাবছে? কেন তারা কৃষিকাজসহ অন্যান্য উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারছে না? সমাজ কেন উদ্যোক্তা মানসিকতার তরুণদের সহজে গ্রহণ করতে পারছে না? আবার উদ্যোক্তা হওয়ার পথও কেন মসৃণ হচ্ছে না? সেগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে।

তরুণদের বিশাল সংখ্যায় নিষ্ক্রিয় থাকা আমাদের অসহায়ত্ব। এদের কীভাবে সম্ভাবনায় রূপান্তর করা যায়, তা নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এটি অবশ্য সামষ্টিক দায়িত্ব। তরুণদের নিজের যেমন সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো উদ্ভাবন করতে হবে, তেমনি অভিভাবক ও সমাজকেও তাকে সমর্থন দিতে হবে। এখানে শিল্প মালিকদেরও দায়িত্ব আছে। আমাদের ভবিষ্যৎ তাদের হাত ধরেই আরও উজ্জ্বল হবে। সেই পথ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। সে জন্য যথাযথ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

সমকালে প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৪

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।