গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলন বা কপ২৬ যখন একটি কাঙ্ক্ষিত সমাপ্তির বদলে খোঁড়াচ্ছিল, তখন সেখানে কিছু প্রতিবাদী কর্মীর উপস্থিতি ছিল অনুপ্রেরণাদায়ক। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর তরুণদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। তাদের সক্রিয়তার কারণে আমরা দেখেছি, দূষণকারী দেশগুলোর বিরুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় অর্জিত হয়। প্রথমবারের মতো এ সম্মেলনে কিছু বিষয় আলোচিত হয়। সম্মেলনে নিম্ন আয়ের দেশ বিশেষ করে যারা জলবায়ু সংকটে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের জন্য অধিক অর্থ দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। জলবায়ু কর্মীদের ক্রোধান্বিত ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে সমাবেশস্থলে। বিশ্ববাসীও তা শুনেছে।
প্রশ্ন হলো, এ সম্মেলন জলবায়ু সংকট উত্তরণে কতটা সফল? গ্লাসগো সম্মেলনে অগ্রগতি হয়েছে বটে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে কয়েকটি রাষ্ট্র যাদের আরও কিছু করার ছিল, তারা সে প্রত্যাশা পূরণ করেনি। এক কথায় সম্মেলন সম্পর্কে বলা যায়, সম্মেলনের ফল শুরুর আগে থেকেই নির্ধারিত। প্রশ্ন- তাহলে এত কনসার্ট, মানববন্ধন, লংমার্চ, সেমিনার, দরকষাকষির আলোচনা, বক্তৃতা, আলটিমেটাম, ঘোষণা ইত্যাদির কি কোনো প্রভাব নেই? আছে নিশ্চয়ই। মিডিয়াতেও তো সেটা দেখা গেছে।
অতীত বলছে, যারা বিশেষত দায়ী সেসব দেশ- সম্মেলনে আসার আগে যে অবস্থানে ছিল, সেখান থেকে তারা কমই বের হয়েছে। আমি মনে করি, আগের কপ বা জলবায়ু সম্মেলনগুলো দেখলেই তা স্পষ্ট হবে। এমনকি ব্যাপক আলোচিত কোপেনহেগেন সম্মেলন যদি আমরা দেখি কিংবা প্যারিস সম্মেলন বা এবারের গ্লাসগো সম্মেলন; প্রতিটিই সে কথা বলছে।
২০০৯ সালের জলবায়ু সম্মেলন বা কোপেনহেগেন সম্মেলন সেভাবে প্রভাব রাখতে পারেনি। কারণ, ওই সম্মেলন শুরুর আগে তেমন আন্দোলন হয়নি। সেখানে বারাক ওবামার মতো নেতাকে খালি হাতে দেশে যেতে দেওয়া হয়। যার কারণে তিনি কোনো রাজনৈতিক মূল্য চুকাননি। প্যারিস সম্মেলনের আগে অনেক দেশেরই কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। তবে তারা একটি চুক্তি করতে সক্ষম হয় এবং তখন একটি কর্মপরিকল্পনাও তৈরি হয়। যদিও সত্যিকার দৃঢ়তা ছাড়া ওইসব লক্ষ্য বাস্তবায়ন সহজ নয়। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়- শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী যে তাপমাত্রা পৃথিবীর ছিল তার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে না বাড়তে পারে। প্যারিস চুক্তিতে অঙ্গীকার করা হয় ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। এবারের গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, ফ্রান্সের প্যারিসে তারা যে চুক্তি করেছে সে ব্যাপারে সবাই তৎপর হবে। এবারের সম্মেলনে যদিও তার কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছতে কারও কারও কর্মকাণ্ড যথার্থ ছিল না। অন্তত গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে সেটিই স্পষ্ট।
২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসটি জলবায়ু তৎপরতার দিক থেকে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। লাখ লাখ মানুষ বিশেষ করে তরুণরা বিশ্বব্যাপী রাস্তায় নেমে আসে। সব মহাদেশে জলবায়ুর কারণে বিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা টুনবার্গের বিশ্ব-জলবায়ু ধর্মঘট চলে। সারা পৃথিবীর দুই সহস্রাধিক শহরজুড়ে 'ফ্রাইডে ফর ফিউচার' আন্দোলনে শামিল হয় ছাত্রছাত্রীরা। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নিস্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে ছিল তাদের এ আন্দোলন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন প্রাপ্তবয়স্করাও। কেবল গ্রেটা টুনবার্গই নয়, ভেনেসা নাকাটে, জিয়ে বাস্তিদা, লুইসা নাবার্গার, আলেক্সান্দ্রিয়া ভিলেসেনর, জেরোমি ফোস্টারসহ অসংখ্য তরুণ জলবায়ু নেতার উদ্ভব ঘটে। তারা যে ঝড় তুলতে সক্ষম হয়, তা ছিল উল্লেখ করার মতো। এর পরই এলো কভিড-১৯। তখন কভিড-১৯ এর কারণে জলবায়ুর তারুণ্যের সেই আন্দোলন সংকুচিত হওয়া শুরু করে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী এ সময় আমরা দেখি নেতৃত্বের এক নতুন ধারা। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা, শি জিনপিং-এর চীন, ব্রাজিলে বলসনারো, তুরস্কে এরদোয়ান, রাশিয়ার পুতিন। নতুন মোড়লদের বিশ্বব্যবস্থায় জলবায়ু আন্দোলন কিছুটা ভাটা পড়লেও অনেকে এখনও সক্রিয়।
সম্প্রতি চীন যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জলবায়ুর ব্যাপারে চুক্তির বিষয়ে জানিয়েছে। সেখানেও অস্পষ্টতা লক্ষণীয়। আমরা জানি, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দুই বৃহত্তম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী। তারা মিথেন নির্গমন হ্রাস, বন রক্ষা এবং কয়লার ব্যবহার বন্ধে চুক্তি করেছে। অথচ জলবায়ু কর্মী ও বিজ্ঞানীদের দাবি সত্ত্বেও তারা জলবায়ুর লক্ষ্য নির্ধারণে বার্ষিক হার ঘোষণা করেনি। কিন্তু তাদের বলবে কে? যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা যে জলবায়ুর ক্ষতি করছে, তা আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কয়েক দিন আগেও বলেছেন। আগামী বছর মিসরে জলবায়ু সম্মেলন তথা কপ২৭ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তখন মার্কিন কংগ্রেসে আবার রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। ফলে আগামী বছর সেখানে কী হয় বলা মুশকিল।
তবে যেহেতু করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়ার হার বাড়ছে, একই সঙ্গে আন্দোলনও দানা বাঁধছে; গ্লাসগোর প্রতিবাদী মার্চগুলোতে আমি আবার সেই প্রবণতা দেখছি। সেখানে টুনবার্গ বলছে, যথাসময়ে যথাকর্মটি করা চাই। তার বক্তব্যের মাধ্যমে অন্যরাও বুঝতে পেরেছে- আসলে গ্লাসগো সম্মেলনে কী হচ্ছে। আমার ধারণা, জলবায়ুর জন্য আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে। আমি মনে করি, অধিক গুরুত্ব দিতে হবে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কারণ, কার্বন নিঃসরণ হার কমানোই বড় চ্যালেঞ্জ।
এবারের গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলন যেভাবে শেষ হলো তাতে এটা স্পষ্ট- প্রতিবাদ ও আন্দোলন কঠোর না হলে জড়তা ও অন্যান্য স্বার্থ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রগুলো স্বপ্রণোদিত হয়ে জলবায়ুর স্বার্থে সব করবে- তা ভাবা রূপকথা ছাড়া আর কিছু নয়। এই অর্থে, গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনের শিক্ষা- অতীতে আমরা কী করেছি সেটা নয়, বরং ভবিষ্যতে আমাদের কী করতে হবে সেটাই বড় বিষয়। এই পৃথিবী ধীরে ধীরে বাসোপযোগিতা হারাচ্ছে। সুতরাং আমাদের সর্বোচ্চটাই করতে হবে।
আমেরিকান লেখক ও পরিবেশকর্মী; দ্য গর্ডিয়ান থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত,ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক