
সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকে একটি সরকারি হাসপাতালের ছবি বেরিয়েছে- করোনা আক্রান্ত রোগী তার ভাইয়ের কাছ থেকে খাবার নিতে নিজেই বাইরে এসেছেন। ছবিটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোচনা হয়েছে। আইসোলেশনে থাকা রোগী বাইরে আসতে পারে কি-না কিংবা তাদের জন্য বাইরের খাবার নেওয়া সিদ্ধ কি-না, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে এটা সত্য যে, এসব রোগীর সেবায় যারা থাকেন অনেকেই কাছে যেতে চান না। করোনা সংক্রামক ব্যাধি বলে বিষয়টি অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু এর বিকল্প সমাধান বিশ্বের অন্যান্যরা দেখিয়েছে। এমনকি চীনের যে উহানে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি সেখানেও হাসপাতালে রোগীর সেবায় নার্স বা অন্যান্য সহযোগী স্টাফের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে রোবট। রোগীর খাবার, ওষুধ ইত্যাদি দেওয়াসহ যেকোনো কাজ অনায়াসেই রোবট করতে পারে। আমাদের দেশেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রোবট তৈরির প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেসব হাসপাতালে করোনা আক্রান্তদের সেবা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে রোবট সার্ভিস দিতে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে তা করা যায়। যদিও জরুরি পিপিই কিংবা মাস্ক এমনকি করোনা চিকিৎসা নিয়েই রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। সেখানে রোবটের বিষয়টি বাতুলতা মনে হতে পারে, তবে অসম্ভব নয়।
বলাবাহুল্য স্বাভাবিক জীবন-যাপনেই আমরা ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। আর করোনা সংক্রমণের এ সময়ে অধিকাংশ মানুষই ঘরে থাকছেন বলে 'ঘরে থাকা' নিশ্চিত করাসহ বাইরের কাজ ঘরে থেকে সম্পাদন করতে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ওপর আমরা অনেকেই বলা চলে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। ঘরে থেকে চাই দেশ-বিদেশের খবর নিতে; বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সে ব্যবস্থাই করে দিচ্ছে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমসে 'দ্য ভাইরাস চেঞ্জড দ্য ওয়ে উই ইন্টারনেট' শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, করোনার কারণে ঘরে থাকা মানুষ ইন্টারনেটে কত বেশি পরিমাণে সময় ব্যয় করছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র উঠেলেও আমাদের অবস্থা খুব বেশি এদিক-ওদিক হওয়ার কথা নয়। অনুসন্ধান করলে নিশ্চয়ই দেখা যাবে- ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগের জন্য যেমন এখানে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ইত্যাদির ব্যবহার যেমন বেড়েছে; তেমনি বহুমুখী যোগাযোগের জন্য বেড়েছে জুম, গুগল-মিট, স্ট্রিম ইয়ার্ড ইত্যাদির ব্যবহার। অনেকেই বাসায় থেকেই লাইভে নিজে একা কিংবা অন্যদের সংযুক্ত করে আলোচনা করছেন। এখানে ভার্চুয়াল দর্শক দেখছে, প্রতিক্রিয়াও দিতে পারছে।
করোনার এ সময়ে দেশে সবচেয়ে যুগান্তকারী বদল ঘটেছে- ঘরে থেকে অফিস করা। ধারণাটি হয়তো বিশ্বে নতুন নয় কিন্তু বাংলাদেশে এর বাস্তব রূপ আমরা এখন দেখছি। এ দুর্যোগে মানুষ খবর চায়। সংবাদমাধ্যমও দেশ-বিদেশের সংবাদ প্রদান করে তার দায়িত্ব নিরলসভাবে পালন করছে। এ সময়ে সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের অধিকাংশই ঘরে থেকে অফিস করছে। সংবাদমাধ্যম ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও ঘরে থেকে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে কেউ টিম ভিউয়ারসহ রিমোট সার্ভার ব্যবহার করছেন। কেউ অফিসের নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও সফটওয়্যারে কাজ করছেন কিংবা ই-মেইলসহ অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমে নির্দেশনা নিচ্ছেন, কাজ সম্পন্ন করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বড় কোনো ঝামেলা ছাড়াই সুন্দরভাবে ঘরে চলছে অফিস কার্যক্রম।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বন্ধ নেই শিক্ষা কার্যক্রম। সীমিত পরিসরে হলেও সংসদ টিভির মাধ্যমে সরকার যেমন বাচ্চাদের শ্রেণিকক্ষের পাঠদান করাচ্ছে। তেমনি (ব্যাকবোন স্কুলের মতো) বেসরকারি অনেক উদ্যোগও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে এগিয়ে এসেছে। বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন পাঠ তৈরি করে তার ভিডিও দিচ্ছে সংশ্নিষ্ট ওয়েবসাইট, ইউটিউব কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ধরনের কাজ আগে থাকলেও লকডাউনে বেড়েছে। উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তেমনি সরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও বসে নেই। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন সব কলেজকে অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস নিতে নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করছে।
করোনা থেকে সুরক্ষায় সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থার সমাধান যেমন ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি দেখাচ্ছে, তেমনি করোনাদুর্যোগেও প্রযুক্তির ব্যবহার করছে বিশ্ব। শুরুতেই হাসপাতালে রোবট কাজে লাগানোর বিষয়টি এসেছে। আমরা দেখেছি, ভারতের কেরালা রাজ্যে 'লকডাউন' মানুষ মানছে কি-না পুলিশ সেটি পর্যবেক্ষণ করছে ড্রোনের সাহায্যে। অনেক দেশে সিসিটিভির মাধ্যমে করোনা পজিটিভ রোগীর অবস্থান, কার কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে ইত্যাদি শনাক্ত হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়াসহ কিছু কিছু দেশ স্মার্টফোন ট্র্যাকিং পদ্ধতি ব্যবহার করছে। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগও যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে না তা নয়, করোনার নিয়মিত তথ্য আমরা স্বাস্থ্য অদিপ্তরের অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমেই পাচ্ছি। আমাদের করোনা বিষয়ে ওয়েবসাইটে রয়েছে বিস্তারিত তথ্য। এমনকি করোনার পরীক্ষার ব্যাপারটিই মোবাইলে হটলাইন নম্বরে ফোন, এসএএমএস ও ই-মেইলের মাধ্যমেই প্রথমে নিশ্চয়ন করা হয়।
এ সময় মানুষ ব্যাংকে যেতে না পারলেও অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড, আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ লেনদেন করছেন। অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীও পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্যই লকডাউনে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে বিশ্বের কোথাও কোথাও মানুষকে ফ্রি ইন্টারনেট সার্ভিসও দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির সুবিধা এটিই যে, এসব কোনো সময় কিংবা দেশের সীমানা মানে না। করোনাভাইরাসের এ সময়ে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার বিশ্বের প্রচলিত অনেক ধারণাই পাল্টে দিচ্ছে। এমনকি এটি বদলে দিতে পারে ভবিষ্যত কাজের ধরনও। ঢাকা শহরে স্বাভাবিক সময়ে রাস্তার যে ভোগান্তি; যানজট ঠেলে আগে যেমন মানুষ অফিসে যেত, এখন অনলাইনে সেটি করছে। অবস্থা স্বাভাবিক হলেও অনলাইন অফিসের চর্চা থেকে যেতে পারে। যদিও ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার নেতিবাচক দিকটিও অস্বীকার করা যাবে না। তারপরও প্রয়োজনই আবিস্কারের জননী। সেভাবেই এসেছে ইন্টারনেট-প্রযুক্তি। করোনা থেকে সুরক্ষায় এর সর্বোচ্চ ব্যবহার সময়েরই বাস্তবতা।
- সমকাল সম্পাদকীয় বিভাগে প্রকাশিত, ০৭ মে ২০২০
- ই-সমকাল হতে দেখুন
- ছবি: টাইম ম্যাগাজিন ও ব্যাকবোন স্কুলের ফেসবুক
[…] সময় লিখেছিলাম, ইন্টারনেট নির্ভরতার কাল। ২০২০-২১ সালে করোনাভাইরাসের […]