
শিক্ষাব্যবস্থায় 'ব্যাপক' পরিবর্তন আসছে বলে আমরা সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম থেকে জানছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে পরিবর্তন যেমন ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে, তেমনি নেতিবাচকও হতে পারে। পরিবর্তন যাতে ইতিবাচক হয় সেটাই কাম্য। সে প্রত্যাশায় আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা- প্রতিটি স্তরেই যে বড় পরিবর্তন আসছে, তা নিয়ে আমি আগাম তিনটি ছোট প্রশ্ন রাখতে চাই।
তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা নেই, পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী কেন : শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তনের কথা আমরা শুনছি, এর মধ্যে সবচেয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়া। শিশুদের সুন্দর, সুষম ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বিকাশে এটি সত্যিই জরুরি। পরীক্ষা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। ছোটবেলা থেকেই যেভাবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার চাপে পিষ্ট, যেভাবে শিশু ও অভিভাবকের মধ্যে পরীক্ষায় 'ভালো ফল'-এর জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালু রয়েছে; যেভাবে শিশুরা কোচিং-প্রাইভেট টিউটরের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে, তা থেকে নিস্কৃতি পেতে পরীক্ষা বাদ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সিঙ্গাপুর ও ফিনল্যান্ডের মতো শিশুদের পরীক্ষা উঠিয়ে দিয়ে আনন্দদায়ক পরিবেশে শিক্ষার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এটা হয়তো ঠিক; সিঙ্গাপুর-ফিনল্যান্ডের মতো পরিবেশ-পরিস্থতি আমাদের নেই। আমরা জানি, ফিনল্যান্ডে শিশুদের ১৬ বছর পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই নেই। আমরা তাদেরটা পুরোপুরি না হোক, কিছু তো অনুসরণ করতে পারি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়া যতটা উপকারী; পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী ততটাই অপকারী।
চতুর্থ শ্রেণি থেকে পরীক্ষা চালু হলে পঞ্চম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা থাকার কোনো যুক্তিই নেই। বিদ্যালয়ের নিজস্ব পরীক্ষা থাকতেই পারে। কিন্তু প্রতি বছর যেভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে পিইসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার নেতিবাচক দিকগুলো দিন দিন প্রকটভাবে ফুটে উঠছে। এ প্লাস পাওয়ার সাধনায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের আদাজল খেয়ে নামা কিংবা কোচিং-প্রাইভেট ও পড়াশোনার চাপে পিষ্ট হওয়া তো রয়েছেই; একই সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের মধ্যে নকলের প্রবণতা, শিক্ষকদের নকল সরবরাহ, পরীক্ষার হলে অসৎ সহযোগিতা ও নম্বর বাড়িয়ে পাসের সংখ্যা ও জিপিএ বাড়ানোর অঘোষিত 'নির্দেশনা'র কারণে পিইসি পরীক্ষা পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষার স্বার্থে ও শিশুর বিকাশে এ পরীক্ষা তুলে দেওয়া জরুরি। আমরা মনে করি, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব পরীক্ষা ও পঞ্চম শ্রেণির শেষে সমাপনী পরীক্ষা দুই-ই উঠিয়ে দেওয়া হোক।
একাদশে দুই পরীক্ষা, অভিন্ন বই; কতটা পরিকল্পিত : সাধারণভাবে পরিবর্তনের ব্যাপকতা বলতে আমরা কাঠামোগত পরিবর্তন বুঝি। এখন অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পর জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। নতুন পদ্ধতি পাস হলে পাবলিক পরীক্ষা হবে পরপর দুই বছর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে। এখন ষষ্ঠ শ্রেণির পর থেকে ১২-১৪টা পর্যন্ত বই পড়ানো হয়। পরিবর্তিত সিলেবাস অনুসারে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাই ১০টি বই পড়বে। এখানে বইয়ের সংখ্যা কমানো ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাস আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পরপর দুটি পাবলিক পরীক্ষার ব্যাপারে খটকা লাগবেই। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা কমছে, শিক্ষার্থীদের চাপও কমছে। কিন্তু এর পর এক বছরের ব্যবধানে দুটি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবা যেতে পারে। এমন হতে পারে, আগের মতোই এইচএসসি পরীক্ষা হলো। আর আগের মতোই দশম শ্রেণির পর এসএসসি পরীক্ষা হতে পারে। সেটা এর আগের এক বছরের অভিন্ন সিলেবাসেই হতে পারে। তাতে জেএসসি উঠে গেল। আর পরীক্ষায়ও ভারসাম্য এলো।

বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল থেকে নতুন পদ্ধতি কার্যকর হবে। আপাতদৃষ্টিতে ২০২৫ খুব দূরে মনে হলেও আসলে দূরে নয়। কারণ এখানে অনেক বড় কর্মযজ্ঞ রয়েছে। প্রথমেই কারিকুলাম ঠিক করতে হবে। তারপর সে অনুযায়ী বই প্রস্তুতকরণ। তার চেয়েও বড়- এ অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ। তারও আগে প্রশ্ন হলো- মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের এই যে পরিবর্তন, তা কতটা পরিকল্পিত? কিংবা এর দ্বারা আমরা কী অর্জন করতে চাইছি, যেটার ঘাটতি বর্তমান পদ্ধতিতে রয়েছে? এখন আমাদের শিক্ষায় পাসের হার, ভালো জিপিএ ইত্যাদি দিয়ে সংখ্যাগত অর্জন তো কম নয়। এখন ঘাটতি কেবল শিক্ষার গুণগত মানে। এ মান অর্জনে নতুন পদ্ধতি কতটা ভূমিকা পালন করবে; সেটাই আগে ভাবতে হবে। কাঠামোগত এ পরিবর্তনেও সেটি অর্জিত হতে পারে না। তবে আরও চিন্তাভাবনা করে; শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও সংশ্নিষ্টদের নিয়ে কাঙ্ক্ষিত ও যথার্থ পরিবর্তন যেন হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা দরকার, শিক্ষা নিয়ে বারবার এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ নেই। ঘন ঘন পরিবর্তন টেকসইও হয় না।
উচ্চশিক্ষায় সমন্বিত ভর্তি, কতটা দেবে স্বস্তি : দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার দাবি অনেকের এবং অনেক দিনের। সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হোক, সেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীও চেয়েছেন। ফলে গত বছর থেকেই এ দাবি আরও জোরালো হয়। তারই আলোকে আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সমন্বিত ভর্তির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। এমনকি ছয়টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ বছরেই এটি কার্যকর করেছে। ২৩ জুন উপাচার্যদের ইউজিসির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী বছর থেকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করবে। যদিও এ ব্যাপারে এখনও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর) সিদ্ধান্ত নেয়নি। উপাচার্যদের সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকেই এর পক্ষে যেমন মতামত দিয়েছেন অনেকে; আবার অনেকেই এর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। উভয় পক্ষেরই যুক্তি রয়েছে।

সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে; খরচ ও সময় সাশ্রয় হবে বলে এর পক্ষে যুক্তি আছে। আবার এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হবে। এখানে দুর্নীতি প্রবেশ করলে গোটা দেশের ভর্তিই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কিংবা একজন শিক্ষার্থী কোনো কারণে একদিনের পরীক্ষা মিস করলে সে আর ওই বছর ভর্তি হতে পারবে না ইত্যাদি যুক্তি রয়েছে এর বিপক্ষে। তবে অস্বস্তির জায়গাটি বুয়েটসহ পাঁচটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। ইউজিসি চেয়ারম্যান যদিও বলেছেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না এলেও তারা সমন্বিত পদ্ধতি কার্যকর করবেনই। তার পরও কিন্তু স্বস্তি আসবে বলে মনে হয় না।
প্রশ্নগুলো হয়তো অনেকেই করেছেন বা করছেন। এগুলোর সমাধানই একমাত্র পথ, তা নয়। প্রশ্ন আসছে, আসবে। তবে পঞ্চম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেওয়াই উচিত। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আরও ভাবার অবকাশ রয়েছে। আর সমন্বিত ভর্তির ব্যাপারে সব বিশ্ববিদ্যালয় ঐকমত্যে পৌঁছুক।