বাস বা ট্রেনের টিকিট পেতে নির্ঘুম রাত- এ রকম পীড়াদায়ক খবরে স্বস্তির বিষয় বোধ হয় চারটি নতুন লঞ্চ উদ্বোধনের খবর। বিশেষ করে দেশের 'সর্ববৃহৎ' নৌযান সুন্দরবন-১০-এর উদ্বোধন বরিশালগামী যাত্রীদের জন্য আনন্দের খবরই বটে। প্রতিবছর ঈদ উপলক্ষে বেশ ভালো বেগ পেতে হয় যাত্রীদের। কি লঞ্চে, কি বাসে, কি ট্রেনে। টিকিট নেই; যাত্রীর তুলনায় আসন কম; লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন; ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ইত্যাদি নানা সমস্যা মাথায় নিয়েই সবাই ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি যান। আবার কর্মস্থলে ফেরেন।
রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম লঞ্চ। ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, মংলা বন্দর, কাউখালী, হাতিয়া, দৌলতখাঁ, বোরহান উদ্দিন, সুরেশ্বরসহ ৪০টির অধিক রুটে লঞ্চ চলাচল করে। সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় একতলা, দোতলা, তিনতলা এমনকি চারতলা পর্যন্ত রয়েছে লঞ্চ, রকেট, স্টিমার প্রভৃতি নৌযান। নদীমাতৃক দেশে নদীকেন্দ্রিক যানবাহন লঞ্চে ভ্রমণ যেমন আরামদায়ক, তেমনি ব্যয়ও তুলনামূলক কম। লঞ্চে ট্রাফিক জ্যামের বালাই নেই, নানা জায়গায় যাত্রী ওঠানামার ঝামেলা নেই, সফরের ক্লান্তি নেই, মাথাব্যথার আশঙ্কা নেই বরং শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে আরাম করে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। সামর্থ্যবানদের জন্য যেমন সামর্থ্যানুযায়ী ভালোভাবে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, তেমনি নিম্ন শ্রেণির মানুষও কম খরচে লঞ্চে যেতে পারেন। তবে দিন যত যাচ্ছে, লঞ্চের আকার যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে সুযোগ-সুবিধা। আধুনিক উপকরণ ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে এগুলোতে। বাজারে টেকার প্রতিযোগিতায় আগেরটাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো লঞ্চ আসছে। শনিবার উদ্বোধন হওয়া ঢাকা-বরিশাল লঞ্চ সুন্দরবন-১০ নিয়ে শুক্রবার সমকাল লিখেছে, 'রীতিমতো রাজসিক'। দেশে প্রথমবারের মতো এ লঞ্চে যেমন ডুপ্লেক্স কেবিন আছে, তেমনি আছে লিফট, আইসিইউ, ইন্টারনেট ও এটিএম বুথ সুবিধা। প্লে গ্রাউন্ড ও ফুডকোট এরিয়াও রাখা হয়েছে তাতে।
দক্ষিণবঙ্গের বরিশালের মানুষ বেশিরভাগই রাজধানীর সঙ্গে যাতায়াতে লঞ্চ সার্ভিসের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। ফলে দেখা যাচ্ছে, নির্মাণশৈলীর দিক থেকে বরিশালের লঞ্চগুলো এগিয়ে। নতুন লঞ্চ সুন্দরবন-১০ ও পারাবাত-১২ ছাড়াও গত বছরের শেষ দিকে ৫ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার দুটি লঞ্চ উদ্বোধন হয়। বরিশালের পর বিশেষত চাঁদপুরসহ কয়েকটি জেলার মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করে। ঈদের আগে আগে বরিশালের দুটি লঞ্চের বাইরে চাঁদপুর রুটেও দুটি লঞ্চ চালু হচ্ছে। এগুলো অবশ্য কেবল ঈদ উপলক্ষে নয়, বরং নিয়মিত হিসেবেই চালু হচ্ছে। তবে ঈদে লঞ্চগুলো চালু হওয়ায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের ঈদযাত্রায় কিছুটা হলেও ভোগান্তি কম হবে।
গত কয়েক বছর বেসরকারি পর্যায়ে অনেক রাজসিক লঞ্চ এসেছে। এগুলো যেমন যাত্রীদের ভ্রমণ আরামদায়ক করেছে, তেমনি ব্যবসায়ও সফল। একইসঙ্গে লঞ্চ, জাহাজ শিল্পে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পরিচায়ক। বরিশাল অঞ্চলের কথা বাদ দিলেও লঞ্চ ভ্রমণে সুবিধার কারণে অনেকে স্থলপথে যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকলেও জলপথকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।
তাছাড়া ঈদের সময় ট্রেন-বাসের টিকিট নিয়ে যতটা নৈরাজ্য হয়, লঞ্চের ক্ষেত্রে তা কমই বলা যায়। লঞ্চের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যদি দেশের একটি অঞ্চলের যাতায়াতের দুর্ভোগ লাঘব হয়, তা নিশ্চয়ই অনেক বড় বিষয়। সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে হয়তো আজ আমরা সুন্দরবন-১০কে বাংলার টাইটানিক উপাধি দিতে পারি। তবে আগামীকাল যে এর চেয়েও ভালো কিছু অপেক্ষা করছে, তা আমরা বলতেই পারি।