১৯৭১ শুনলেই আমরা চলে যাই ৪৩ বছর আগে। মানসপটে ভেসে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের চিত্র। যে চিত্র গৌরবের, আত্মত্যাগের। জীবনের মায়া ত্যাগ করে স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার সে চিত্র আমাদের অশ্রুসিক্ত করে। '১৯৭১ : বিস্মৃত সেই সব শহীদ' বইতে ইজাজ আহমেদ মিলন সে চিত্রই দেখিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রক্ত-মাংসের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে, ১৯৭১-এর পর জন্ম হলেও যেন আমরা সেই যুদ্ধের অগ্রসেনানি ছিলাম, যেন সেদিনের বিজয় আমাদের চোখেও ভাসছে। মুক্তিযুদ্ধকে এভাবে দেখানোর কৃতিত্ব অনেকের। ইজাজ আহমেদ মিলন সে কাতারের একজন। তিনি নিজেও বইটিতে লিখেছেন_ 'আমি বিজয় দেখিনি'। তারপরও তিনি বিস্মৃত শহীদদের নিয়ে লিখেছেন। সমকালের শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি হিসেবে শ্রীপুরের ২৫ শহীদকে খুঁজে বের করে তিনি সাংবাদিকতাকেই মহিমান্বিত করেননি একই সঙ্গে বিস্মৃতদের সবার সামনে এনে অসাধারণ কাজও করেছেন।
বইটি মূল্যায়নের জন্য এর চেয়ে বড় কথা আর কি হতে পারে। লেখক প্রত্যেক শহীদের নাম লিখে তার অবস্থা বর্ণনায় একেকটা শিরোনামও দিয়েছেন। শিরোনামগুলো সত্যি আবেগময়। যেটি যথার্থভাবে কাহিনীকেও প্রতিনিধিত্ব করেছে। 'শহীদ জামাল উদ্দিন : ৪৩ বছরেও থামেনি কন্যার সে কান্না', শহীদ সিরাজুল ইসলাম : অভাবের আগুনে ঝলসানো সংসারে তার জন্ম' কিংবা 'শহীদ জহির উদ্দিন : কষ্টগুলো পাথর হয়ে গেছে'। প্রত্যেকটি কাহিনী বর্ণনায় লেখক বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। প্রথমে শহীদের যুদ্ধে যাওয়ার অবস্থা পটভূমি এনেছেন অসাধারণ ভঙ্গিমায়। তারপর তার সাহসিক কর্মকাণ্ড, শহীদ হওয়ার ঘটনা এবং একই সঙ্গে সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও তুলে ধরেছেন। গোটা শ্রীপুর ঘুরে ঘুরে নানা জনের সহযোগিতায় শহীদদের বাড়ি বের করেছেন। শহীদদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের বর্তমান অবস্থাও লিখতে ভোলেননি। এমনকি প্রত্যেক শহীদ পরিবার খুঁজতে কারা কারা সহযোগিতা করেছেন প্রত্যেক কাহিনীর শেষে তাদের ঋণও স্বীকার করেছেন লেখক।
মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। সেই মৃত্যু যদি দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য হয় তা নিশ্চয়ই গৌরবের। সে মৃত্যু অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎসও বটে। ইজাজ আহ্মেদ মিলনের বইও সে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। যদিও কিছু হারানোর কোনো প্রবোধ হয় না। বাবা হারানো কতটা কষ্টের তা সন্তান ছাড়া অন্যদের বোঝার কথা নয়। তারপরও সে অনুভূতি যখন লেখক তুলির আঁচড়ে তুলে আনেন পাঠক তা বোঝেন। অজান্তে চোখে পানি ছাড়েন। লেখক বইয়ে সে চেষ্টাই করেছেন।
সবার ওপরে দেশ। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে চাই আমরা। প্রত্যেককে এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে। বইয়ে শহীদ মাজম আলী মৃধার ভাতিজার কণ্ঠও বেজেছে, 'শহীদ একটি পরিবারে আমাদের জন্ম হয়েছে বলে আমরা গর্ববোধ করি। চাচার রক্তে কেনা এ দেশ আমার। এ দেশের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। এ দেশটাকে আমরা আমাদের মতো করে সাজাতে চাই।' শহীদরা তো দূর থেকে তাই বলছেন। আর লেখকও বুঝি সেটাই স্মরণ করাচ্ছেন!