বাস্তবের নদীর সঙ্গে চোখের নদীর মিল আছে। কাঁদলে চোখ দিয়ে যে পানি বের হয় তার স্বাদ নোনতা, অনেক নদীর পানিও নোনতা। চোখের পানি, নদীর পানি উভয়ই তরল। সত্যিকার নদীর মতো চোখের নদীও শুকিয়ে যায়_ এ রকম মিলের অভাব নেই। মিল না থাকলেও কল্পনায় মিল পাওয়া যায়। পাহাড়ি ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়ে নদীর সৃষ্টি; সেটা পাহাড়ের কান্না। আর মানুষের হৃদয়ের বেদনা প্রকাশের কান্নায় সৃষ্টি হয় চোখের নদী। বাস্তবের নদীর মতো চোখের নদীতে ডুব দেন অনেকে। সাঁতরানো, ঝাঁপ দেওয়া কত কিছুই না হয়। উভয় নদীতে জোয়ার হয়, ভাটা আসে। উভয়ের সুদিন আছে, আছে দুর্দিন। তারপরও চোখের নদী যেন বেদনারই বহিঃপ্রকাশ; যেন দুঃখেই সৃষ্টি হয় নদী। অথচ খুশিতেও তো মানুষ কাঁদে। আনন্দাশ্রু যাকে বলে। বাস্তবের নদীও কি বেদনার ফসল, পাহাড় কি কেবলই কাঁদে, তারও তো আনন্দাশ্রু থাকার কথা। তবে তা বোধহয় কমই দেখা যায়। আজকাল নদীর কথা বললেই যেন দুঃখের খবর। নদীকে ঘিরেও সেই দুঃখ। অন্তত সোমবার সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের কুওয়াইক নদীতে যা দেখা গেল তাকে দুঃখ ছাড়া কীভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সিরিয়ার সংকটের কথা সবার জানা। সেখানে অনেক দিন ধরে সরকার এবং বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এ ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা কম নয়। এখন যে ২০ জনের লাশ পাওয়া গেল, তা বিশ্ববাসীকে বেদনাহত না করে পারে না। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত বস্তান আল-কাসর দিয়ে বয়ে যাওয়া কুওয়াইক নদীতে ওই মরদেহগুলো পাওয়া যায়। মরদেহগুলোর কারও কারও হাত বাঁধা ছিল। অনেকের মাথায় গুলি ও গলায় ছিল গুরুতর ক্ষতের চিহ্ন। কারও মুখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। সম্প্রতি আমরা দেশেও নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাবি্বর বড় ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর হত্যাকাণ্ড দেখেছি। বৃহস্পতিবার থেকে নিখোঁজ ত্বকীকে শুক্রবার সকালে উদ্ধার করা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় থেকে। নদীতে এ রকম অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথাও অজানা নয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আবার নিষ্পাপ মানুষও নদীতে পড়ে মারা যায়_ এ রকম ঘটনাও কম নয়। এসব ঘটনায় নদীর সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও যেন নদীকে ঘিরেই সব। এসবই দুঃখের খবর।
অথচ এই নদীকে ঘিরেই তো আমরা বলি নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। যে নদী এখনও আমাদের যোগাযোগের, পর্যটনের, আয়ের অন্যতম মাধ্যম। তবে নদীর সেই রূপ দিন দিনই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীর খবর মানেই এখন 'হারিয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে, দখল হচ্ছে, দূষণ হচ্ছে' ইত্যাদি সবই খারাপ খবর। আর তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে নদীকেন্দ্রিক হত্যাকাণ্ড। যেন সেই বেদনার চোখের নদী বাস্তবের নদী। যে নদী আমাদের কাঁদায়_ একে ঘিরে ক্রাইম জোন গড়ে উঠছে বলে, একে কেন্দ্র করে অবৈধ ব্যবসা চলছে বলে, এটি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বলে। তবে এসবের পেছনেই রয়েছে মানুষ। মানুষের আচরণেই নদী এই রূপ ধারণ করেছে। এর শেষ কোথায়?