Mahfuzur Rahman Manik
গফরগাঁওয়ের আয়নায় প্রাথমিক শিক্ষাচিত্র
সেপ্টেম্বর 14, 2022
গফরগাঁওয়ের বারইহাটি-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে পাঠদান - সমকাল ০৬ সেপ্টেম্বর ২২

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার যে উন্নয়ন ঘটেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক এবং নীতিগতভাবে অনেক ভালো সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে স্কুল পর্যায়ে অনেক কিছুই সেভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বাস্তবে কী হচ্ছে, একটি উপজেলার অবস্থা দিয়ে তা অনুমান করা কঠিন নয়। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সমকালে ৬ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেখানে যে বিষয়গুলো এসেছে, তা নিয়েই এ লেখার প্রয়াস।
প্রথম বিষয়টি শিক্ষার্থী উপস্থিতি নিয়ে। গত আগস্ট মাসে সপ্তাহব্যাপী পর্যবেক্ষণ করে সমকালের প্রতিবেদক দেখেছেন, গফরগাঁওয়ের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি নয়। সমকালের ৬ সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন- 'একজন, দু'জন শিক্ষার্থী নিয়েই ক্লাসে পাঠদান।' এমনকি কোনো কোনো শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষার্থীও উপস্থিত ছিল না। একটি বিদ্যালয়ে কাগজ-কলমে ১২৯ শিক্ষার্থী থাকলেও তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম- এ তিন শ্রেণিতে মোট উপস্থিতির সংখ্যা ১৩। কোথাও ১১০-এর মধ্যে তিন শ্রেণিতে উপস্থিত ছিল মাত্র ১০ শিক্ষার্থী। উপস্থিতির এ দুর্দশার সঙ্গে আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে। তা হলো শিক্ষকদের সংখ্যা। একটি বিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষকের পদ থাকলেও তিনটিই শূন্য। ওই বিদ্যালয় পরিদর্শনের দিন সমকালের প্রতিবেদক কেবল একজন শিক্ষককে পেয়েছেন, যিনি একটি কক্ষে একসঙ্গে তিনটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একাই পড়াচ্ছিলেন।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি এবং শিক্ষকের পদশূন্যতা উভয়ই উদ্বেগের। কিন্তু শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির বিষয়টি বেশি শঙ্কার। হাজিরা খাতায় থাকলেও বাস্তবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী নিয়মিত উপস্থিত না থাকলে ঝরেও যেতে পারে। সে জন্য কোনো শিক্ষার্থী নিয়মিতভাবে অনুপস্থিত থাকলে শিক্ষকদের দায়িত্ব বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীর খোঁজ নেওয়া। এ ছাড়া ফোন করে শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গেও কথা বলা যেতে পারে। এমনিতেই গত দুই বছর করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এখন নতুন করে সেখানে ঝরে পড়া আরও চিন্তার বিষয়। শ্রেণিকক্ষে নূ্যনতম সংখ্যক শিক্ষার্থী না থাকলে এক-দু'জনের ক্লাস অনেক সময় ফলপ্রসূ হয় না। দ্বিতীয় যে বিষয়টি এসেছে, সেটি হলো আর্থিক অনিয়ম। গফরগাঁও উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সমকালে প্রকাশিত সিরিজ প্রতিবেদনের দুটি এ সংক্রান্ত। একটি হলো, কাজ না করেই টাকা তোলা এবং আরেকটি, শিক্ষা উপকরণ কেনা হয়নি; বরাদ্দের টাকা নিয়ে ধোঁয়াশা। কাজ না করে অর্থ তোলা কিংবা সরকারের বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও সে খাতে খরচ না করার মতো অনিয়ম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য দুঃখজনক। বিদ্যালয়প্রধানের উচিত সরকারের বরাদ্দ সঠিক খাতে খরচ করা। যেখানে শিক্ষকরা উদ্যোগী হয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয়ের ব্যাপারে তৎপর হবেন, সেখানে তা 'মেরে খাওয়া'র প্রবণতা কেন?
তৃতীয় যে বিষয়টি আমরা দেখছি, বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ বেদখল হওয়া। সমকালের প্রতিবেদনমতে, গফরগাঁওয়ের বেশ কয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ দখল করে সেখানে বীজতলা তৈরি হয়েছে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা সেখানে খেলতে পারছে না। মাঠ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা কেন বঞ্চিত হবে? আমরা জানি, শিশুদের খেলাধুলার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে মাঠ থাকা জরুরি। শহর এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠের জায়গা পাওয়া যায় না। অথচ গফরগাঁওয়ের মতো এলাকায় মাঠ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা খেলতে পারছে না। বিদ্যালয়ের মাঠ কীভাবে দীর্ঘদিন বীজতলা হিসেবে ব্যবহূত হয়? বিদ্যালয় প্রশাসন কেন এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারছে না? দখলদাররা প্রভাবশালী হলে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে হলেও এর সুরাহা হতে পারে।
চতুর্থত, বিদ্যালয়ের সম্পদ সংরক্ষণে সংশ্নিষ্টদের নির্বিকার থাকার সুযোগ নেই। অথচ সমকালের প্রতিবেদন বলছে, পোকার পেটে ৪ কোটি টাকার বই। একটি উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চিত্র যদি এমন হয়, তবে সারাদেশে কত অর্থ এভাবে অপচয় হচ্ছে? সরকার প্রতিবছর বিনামূল্যে যেভাবে বই বিতরণ করছে, তাতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছে। বছরের প্রথম দিনে বই উৎসব আমাদের শিক্ষার অনন্য উদ্যোগ। বিদ্যালয় থেকে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই যেহেতু বই দেওয়া হয়, সেহেতু প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বশীল হতেই হবে। অযথা অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে সরকারের অর্থ জলে ফেলার হেতু কী?
এখানে আরেকটি প্রশ্ন সংগত- তাহলে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী কোত্থেকে এসেছে? একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিতি, অন্যদিকে বিতরণের মতো শিক্ষার্থী না পাওয়ার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি? মানে বাস্তবে শিক্ষার্থী না থাকলেও অতিরিক্ত শিক্ষার্থী দেখানো হচ্ছে কিনা- খতিয়ে দেখা দরকার। প্রতিবেদনে এ-ও এসেছে, কোনো কোনো শিক্ষার্থী কেজি স্কুলে পড়ছে; একই সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও পড়ছে। এমনকি একজন অভিভাবক সমকালের প্রতিবেদকের কাছে বলেছেন, 'ভালো পড়ালেখার জন্য কেজি (কিন্ডারগার্টেন) স্কুলে বাচ্চাদের পড়াই। আর উপবৃত্তির জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করি।' এটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক বাস্তবতা। শতভাগ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসুক এটা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি তাদের নিয়মিত উপস্থিতিও উপেক্ষা করা চলবে না।

সমকালে প্রকাশিত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।