
টিভিতে অনেকে রেসলিং বা কুস্তি খেলা বুঁদ হয়ে দেখেন। দু'জন কুস্তিগির নিজের শারীরিক ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে জেতার চেষ্টা করেন। দর্শক এসব দেখে আনন্দ পান, বিনোদিত হন, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অন্যান্য খেলার মতোই এটা যেমন প্রতিযোগিতামূলক, তেমনি বিনোদনও। হয়তো মানুষের আগ্রহ থেকেই একেবারে পেশাদার কুস্তি ও কুস্তিগির দেখছি আমরা। ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্টের (ডব্লিউডব্লিউই) কুস্তি বিশ্বে জনপ্রিয়। রেসলিংয়ের বিষয়টি সামনে এলো আমাদের জব্বারের বলী খেলার খবরে। সংবাদমাধ্যমগুলোতে কয়েকদিন ধরে এ খেলার কথা আসছে, বুধবার তা শুরু হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে এখন তাই উৎসবের আমেজ। সেখানে লালদীঘির ময়দানে চলছে ঐতিহাসিক এ বলী খেলা। খেলার পাশাপাশি রয়েছে জমজমাট বৈশাখী মেলা। বাংলা বছরের প্রথম মাস বৈশাখের ১২ তারিখ প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়া এ আয়োজনের জন্য অনেকে অপেক্ষা করেন। অনেককেই বলী খেলা বিনোদিত করে, অনেকে হয়তো কোনো কুস্তিগিরের ভক্ত, তার প্রতিযোগিতা দেখার জন্য উৎসুক হয়ে আছেন।
চট্টগ্রামের জব্বারের বলী খেলার ইতিহাস অনন্য। আজকে হয়তো এটি অনেকের কাছে বিনোদন কিংবা কারও কাছে নিছক খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতা। কিন্তু এর উদ্যোগকে বলা চলে একটি প্রতিবাদ। ১০৮ বছর আগে ১৯০৯ সালে তখন ব্রিটিশ শাসন। ব্রিটিশদের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে অনেকেই নানাভাবে সোচ্চার হয়েছেন। তারই দৃষ্টান্ত আজকের এ বলী খেলা। ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতেই তখন স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর লালদীঘি মাঠে আয়োজন করেন এই কুস্তি প্রতিযোগিতা। ১৩১৬ বর্ষের ১২ বৈশাখ বলী খেলার প্রথম আসর বসে। পরে এ প্রতিযোগিতা ওই সওদাগরের নামানুসারেই জব্বারের বলী খেলা হিসেব পরিচিতি পায়। এরপর থেকে প্রতি বছর ১২ বৈশাখ এ বলী খেলা হয়। বলা বাহুল্য, জব্বারের বলী খেলার সূচনার সঙ্গে রেসলিংয়ের ইতিহাসেরও মিল রয়েছে। কারণ, কুস্তি আসলে প্রাচীন যুদ্ধকৌশলেরই একটি অংশ। উইকিপিডিয়া লিখছে, ১৫ হাজার বছর আগে কুস্তির জন্ম। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় ও মিসরীয় সভ্যতায় কুস্তিগিরদের দেখা মেলে। গ্রিসে কুস্তি মার্শাল আর্টের মতো জনপ্রিয় ছিল। আরবেও কুস্তির প্রচলন ছিল, আরবের উকায মেলায় কুস্তির প্রতিযোগিতা হতো।
দিন দিন কুস্তির ধরন পাল্টেছে। এখন এটি যুদ্ধকৌশল না হলেও, আনন্দ-বিনোদন বা প্রতিযোগিতার বিষয় হলেও এটা ঠিক যে, এর মাধ্যমে শারীরিক কসরত হয়, ব্যক্তির শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে আন্তর্জাতিকভাবে ডব্লিউডব্লিউইর যেসব রেসলিং দেখা যায়, সেখানে পেশাদার কুস্তিগিররা কুস্তি করেন। একজন আরেকজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, সবল দুর্বলকে একের পর এক আঘাত করেন। অনেক সময় পৈশাচিক দৃশ্যও দেখা যায়। এর মধ্যেই জয়-পরাজয় চিহ্নিত হয়। দর্শক আনন্দে ফেটে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এসব রেসলিং বাস্তবতাকে হার মানায়। অনেকে তো বলে, এসব আসলে অভিনয়।
যা হোক, চট্টগ্রামের জব্বারের বলী খেলায় ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও আরাকান অঞ্চল থেকে অনেক নামকরা বলী (কুস্তিগির) অংশ নিতেন। এখন সে রকম পেশাদার কমে গেছে। তারপরও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক বলী 'জব্বারের বলী' খেলায় অংশ নেন।
এ খেলার শুরুর হয়েছিল যে প্রতিবাদ হিসেবে, সেটি হয়তো অনেকেই জানেন না কিংবা অনেকের সে চেতনা নেই। তারপরও ঐতিহ্য হিসেবে এ খেলা জারি থাকুক। প্রতিবছর যখন জব্বারের বলী খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এ নিয়ে মাতামাতির মধ্যেও কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তার ইতিহাসও জানবে- সেটাই-বা কম কিসে!