Mahfuzur Rahman Manik
ঈদযাত্রা কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি প্রয়োজন

সাক্ষাৎকার: ড. মো. সামছুল হক

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মাহফুজুর রহমান মানিক

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. সামছুল হক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। তিনি বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। ঢাকার মেট্রোরেল, হাতিরঝিল প্রকল্পসহ উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক এবং কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের পরিকল্পনাকারীও তিনি। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ থেকে বিএসসি ও এমএসসি অর্জনকারী সামছুল হক পিএইচডি করেছেন ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটন থেকে।

সমকাল: ঈদে বাড়িফেরা আমাদের নিয়মিত অনুষঙ্গ হলেও ঈদযাত্রায় আমরা প্রতি বছরই বিশৃঙ্খলা দেখছি। এখানে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়?

মো. সামছুল হক: ঈদযাত্রায় শৃঙ্খলা ফেরানো অসম্ভব নয়। কিন্তু আমরা সে পথে হাঁটছি না। সংকট মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অগ্রসর না হয়ে আমরা কেবল গায়ের শক্তি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করছি। এ সময় অধিকসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নামিয়ে দিলেই তো সমাধান হবে না। এ জন্য সারা বছর কাজ করতে হবে। নানা কারণে আমাদের সড়কগুলো সর্বোচ্চ সেবা দিতে পারছে না। সেখানে কোথাও সড়কের পাশে বাজার আবার কোথাও অকারণে ভবন উঠাচ্ছি। সড়ক ঠিক না হলে তো ঈদযাত্রাও নির্বিঘ্ন হবে না।

সমকাল: ঈদযাত্রায় অসহনীয় যানজট আমরা দেখি। বিশেষ করে রাজধানী ছাড়তেই দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সামছুল হক: রাজধানীতে সারা বছরই যানজট থাকে। ঈদের সময় এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। বিশেষত ঢাকা ছাড়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখি মোড়গুলোতে প্রচণ্ড চাপ থাকে। সানারপাড়, মৌচাক- এসব মোড়ে কয়েক কিলোমিটার যানজট দেখা যায়। এর সমাধান হিসেবে আমরা কেবল ওই মোড়গুলো মোটাতাজাকরণেই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা নিচ্ছি না। আমরা কুড়িল মোড়ের মতো ব্যবস্থা নিতে পারি, যাতে সব গাড়ি তার নিজ নিজ গন্তব্যে যানজট ছাড়াই সহজে যেতে পারে। এদিকে ঢাকার উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে চলছে নির্মাণকাজ। সেখানে সড়ক সরু হয়ে যাওয়ায় মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে।

সমকাল: তার মানে রাজধানীর উল্লেখযোগ্য সড়কে উন্নয়ন কাজের জন্যও এ বছর ভোগান্তি বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

সামছুল হক: ভোগান্তি অবশ্যই বাড়বে। উন্নয়ন দরকার আছে নিঃসন্দেহে। প্রথমত উন্নয়ন হতে হবে পরিকল্পিত। দ্বিতীয়ত উন্নয়নের ক্ষেত্রে এমন কৌশলী হওয়া প্রয়োজন যাতে মানুষের ভোগান্তি কম হয়। রাতদিন পুরোদমে কাজ করে যেখানে স্বল্প সময়ে কীভাবে কাজ শেষ করা যায় সে নীতি না নিয়ে আমরা ধীরে ধীরে কাজ করে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি সময় নিয়ে ভোগান্তি বাড়াতে ভূমিকা পালন করছি। মানুষও এসব তার নিয়তি হিসেবে ভেবে নিয়েছে। বলাবাহুল্য, আমাদের উন্নয়ন যন্ত্রণা প্রসবযন্ত্রণার চেয়েও বেশি হয়ে গেছে।

সমকাল: ঈদের এ সুযোগে ফিটনেসহীন গাড়ি ও অদক্ষ চালকের সংখ্যাও বেড়ে যায়...।

সামছুল হক: ঈদের সময় যে চাপ থাকে তাতে সংশ্নিষ্টরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবহনের শৃঙ্খলা বিধানেই গলদঘর্ম হয়ে ওঠেন; তখন আর কাগজপত্র দেখার সময়-সুযোগ কিংবা মানসিকতাও থাকে না। এ কারণে আরেকটা ভয়ংকর প্রবণতা দেখা যায়। অনেকে হাইওয়েতে মাইক্রোবাস কিংবা মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি যায়। সড়কে এসব ছোট ছোট যান চলাচল করার কারণে রাস্তার একটা অংশ তারা নিয়ে নেয়। তাতে সড়কের গতি কমে যায় এবং দুর্ঘটনা বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। এমনকি টোল প্লাজায় টোল দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা যে সময় নেয় তার প্রভাবও একেবারে কম নয়।

সমকাল: ঈদের সময়ে সড়কে চাঁদাবাজির বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

সামছুল হক: সড়কে চাঁদাবাজি কেবল ঈদের সময় নয়, সবসময়ই দেখা যায়। এটি অনেকটা ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। এখানে একটা সিন্ডিকেট কাজ করে যেখানে পরিবহন নেতা হতে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যও জড়িত রয়েছে। মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশের দায়িত্বশীল হওয়ার কথা বললেও চাঁদাবাজি থেমে নেই। এটি পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষণ্ণম্ন করছে বলে এ দুষ্টচক্র ভাঙতেই হবে। আমরা মনে করি, পুলিশ যেভাবে অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে, চাইলে তাদের মধ্যকার অসাধুদের ধরাও কঠিন নয়। মহাসড়ক পুরোটা সিসিটিভির আওতায় এনেও কারা চাঁদাবাজি করছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

সমকাল: ঈদযাত্রায় রেল কেন প্রত্যাশার চাপ নিতে পারছে না?

সামছুল হক: এটা খুবই দুঃখজনক, রেল খাত আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। এর পেছনে বাস্তব কারণ অস্পষ্ট নয়। আমরা দেখছি, রেলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, বিনিয়োগ হচ্ছে, অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থ ব্যয় হচ্ছে অথচ সুফল আমরা পাচ্ছি না। কারণ রেলের গতি বাড়ছে না। রেললাইন বাড়লেও উপকার হচ্ছে না। রেলের নির্দিষ্ট গতি নিশ্চিত করতে না পারলে তা কীভাবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে? দ্রুতগতিতে সেবা দিতে পারলে রেলের মাধ্যমে অধিকসংখ্যক যাত্রীর বাড়ি যাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। ট্রেনের গতি কমার কারণ আমরা জানি, রেললাইন ঘিরে অনেক জায়গায় তৈরি হয়েছে বাজার, কোথাও পাশে বস্তি। অনেক জায়গায় লাইনেরও সক্ষমতা নেই। সে জন্য নির্দেশনা থাকে শহর এলাকায় ঘণ্টায় ৩০-৪০ কিলোমিটর গতিতে চালাতে হবে। যে ট্রেন ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে সে ট্রেন কেন আমরা ১০০ কিংবা ৮০ কিলোমিটার গতিতেও চালাতে পারছি না?

সমকাল: ঈদের সময় অতিরিক্তি ভাড়ার বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সামছুল হক: স্বাভাবিক সময়ে যে ভাড়া নেওয়া হয়, ঈদে তার চেয়ে বেশি নেওয়ার কিছু যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত ঈদের সময় চাপটা থাকে একমুখী, ফেরার সময় তারা কাঙ্ক্ষিত যাত্রী পান না। দ্বিতীয়ত, ঈদের সময় চাহিদা বেশি থাকায় জোগান নিশ্চিত করার জন্য তারা বেশি ভাড়া নিতে পারেন। তৃতীয়ত, বছরের অন্যান্য সময় মালিকরা সরকার নির্ধারিত রেঞ্জের মধ্যে ভাড়া নেন। ঈদের সময়েও সরকারি ভাড়ার রেঞ্জেই সর্বোচ্চ ভাড়াটা তারা নিতে পারেন। কিন্তু এর চেয়ে অতিরিক্ত গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন ৩০০ টাকার ভাড়া সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা হতে পারে। ঈদযাত্রায় অনেকে যাত্রীদের জিম্মি করে যেভাবে অতিরিক্ত ভাড়া নেন, তা অগ্রহণযোগ্য। তবে আমরা যদি সিস্টেম ঠিক করতে পারি, অতিরিক্ত ভাড়াও তখন নেওয়া লাগবে না।

সমকাল: ঈদের সময় দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এর নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করা যায়?

সামছুল হক: ঈদের সময় বাড়ি যাওয়ার চেয়েও ফিরতি পথে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। তার নানাবিধ কারণ রয়েছে। ঈদের আগে সড়কে যেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা থাকে, ঈদের পরে সেটা দেখা যায় না। তাছাড়া এ সময় সড়কে ছোট ছোট যান চলাচলের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। মহাসড়কে মোটরসাইকেল ৩০ গুণ ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো অন্তত ঈদের সময় চলতে দেওয়া যায় না। ট্রাক যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেভাবে মহাসড়কে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে নসিমন-করিমনসহ সব ধরনের ছোট যান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না। সেখানে বিআইডব্লিউটিএর পাশাপাশি আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে জলযানের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তাছাড়া আমি মনে করি, পুরো ঈদযাত্রা ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তা কেবল দুর্ঘটনাই কমাবে না একই সঙ্গে যাত্রীর দুর্ভোগও কমাতে পারে।

সমকাল: ঈদযাত্রা কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটর করবে কীভাবে?

সামছুল হক: প্রযুক্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় মনিটরিং অসম্ভব নয়। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে মহাসড়কগুলোকে সিসিটিভির আওতায় আনা সম্ভব। রাজধানীর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সিসিটিভির মাধ্যমে সড়কের অবস্থা সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য জানিয়ে দেওয়া হবে এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সবাই জানতে পারবে। এর মাধ্যমে ঈদযাত্রী অন্তত তার অবস্থান জানতে পারবে। যেমন সামনে বর্ষা মৌসুম। কোনো কারণে একটি ফেরিঘাটের ফেরি অচল হয়ে গেলে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরের যাত্রী জানতে পারবে ফেরি অচল হয়ে আছে। তা জানলে সে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে পারবে। এ ছাড়া কোথাও দুর্ঘটনা হলে বা বিশেষ কারণে যানজট লেগে গেলেও তারও আপডেট পাওয়া যাবে। তাতে যাত্রীরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে কিংবা অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

সমকাল: ঈদযাত্রায় চাপ কমাতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়?

সামছুল হক: ঈদে নির্দিষ্ট কয়েক দিনের চাপ নানাভাবে কমানো যায়। যারা ঈদে পরিবারসহ বাড়ি যান তারা আগেই পরিবারকে বাড়িতে রেখে আসতে পারেন। গার্মেন্টসহ যেখানে একসঙ্গে অনেক জনশক্তি রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটি জোনভিত্তিক আগে-পরে করা যেতে পারে। ছোট যান ঈদের সময় মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সড়কে ও যানবাহনে শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সারা বছর পরিকল্পিত কাজের মাধ্যমে সংকটের সমাধান সম্ভব।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

সামছুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।