Mahfuzur Rahman Manik
দ্য কাশ্মীর ফাইলস : বিজেপির প্রোপাগান্ডা
এপ্রিল 1, 2022
বিতর্কের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' ছবির অনুমোদন দিয়েছেন

মূল লেখক : ফয়সাল হানিফ
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

বলিউডের সাম্প্রতিক জনপ্রিয় সিনেমা 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' রিলিজ হওয়ার পর থেকেই বক্স অফিস কাঁপাচ্ছে। কারণ, এ পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ছবির মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক হিসেবে তকমা পাওয়া ছবিটিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কাশ্মীরি পণ্ডিতরা মুসলিম অধিকৃত কাশ্মীর উপত্যকাকে কৌশলে মুক্ত করেছে। আসলে যা ঘটেছে ছবির কাহিনি সে সত্যের কাছে যায়নি। যেখানে ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে রচিত যে কোনো ছবিতে বিশেষ সংবেদনশীলতা প্রত্যাশিত, সেখানে আমরা দেখছি ভারতীয় শাসক দল বিজেপির অনুদানপ্রাপ্ত ও দলটির বিশেষ উৎসাহের 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' যেন তাদের জন্য আরও বেশি কিছু নিয়ে এসেছে। সিনেমার অতিরঞ্জিত প্লটগুলোর অন্যতম, রক্তপিপাসু মুসলিম কর্তৃক হিন্দু নারীদের খুব কাছ থেকে টার্গেট করে গুলি করা। ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের যে কোনো খারাপ কিছু ঘটার জন্য প্রতিবেশীর ওপর দোষ চাপাতে পারে।
১৯৮৯ সাল থেকে শুরু করে দুই দশকে একটি সংগঠনের হিসাবে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ৬৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ ও সরকারের হিসাবে সংখ্যাটি আরও কম। তবে গবেষক অশোক সোয়ান দেখিয়েছেন, কাশ্মীর ফাইলসে মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়ানোর কথা বলছে। একই সময়ে ভারতীয় সামরিক বাহিনী কর্তৃক হাজার হাজার কাশ্মীরি মুসলমানকে হত্যার কথা বলা হয়েছে, কাশ্মীরজুড়ে গ্রামে গ্রামে চিহ্নহীন গণকবরের সন্ধান এ সম্পর্কেই বলছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের অনেককেই ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে 'জঙ্গি' হিসেবে দেখিয়েছে; যে 'ওয়ার অন টেরর' কাজে লাগিয়ে তার এ বর্বরতাকে এসব 'খারাপ লোকদের' বিরুদ্ধে নিজেকে বাঁচানোর কৌশল হিসেবে দেখানোর সুযোগ পেয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতীয় ছবির বাজার বিশাল। হলিউডের চেয়ে বলিউডে একশ কোটিরও বেশি টিকিট বিক্রি হয়। একই সঙ্গে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলো খারাপ উদ্দেশ্য সাধনে এক জোট হয়ে কাজ করার ইতিহাস আছে। রুপালি পর্দায় যে অমানবিকতা প্রদর্শিত হয় তা সাংঘাতিক। এমনকি ১৯১৫ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন সিনেমার ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। হোয়াইট হাউসে যখন বর্ণবৈষম্যমূলক ছবি 'দ্য বার্থ অব এ নেশন' প্রদর্শিত হয়, তখন তিনি বিষয়টি অনুধাবন করেন। ওই ছবিতে ক্লান্সম্যানকে নায়কের ভূমিকায় দেখানো হয়, যিনি কালো আমেরিকানদের সন্ত্রস্ত করেছিলেন। সেখানে শ্বেতাঙ্গ অভিনেতারা কৃষ্ণ চেহারায় খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি যেন ক্লু ক্লাক্স ক্লানকে (কেকেকে) পুনরুজ্জীবিত করেছিল। বলা বাহুল্য, কেকেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যার নতুন অধ্যায় শুরু করেছিল।
এডলফ হিটলারের নির্দেশে জার্মানির নাৎসি বাহিনীও একটি ছবি তৈরি করেছিল। 'ট্রায়াম্ম্ফ অব দ্য উইল' নামে ওই সিনেমায় ১৯৩৪ সালের নাৎসি বাহিনীর কংগ্রেসের ইতিহাস উঠে আসে, যেখানে সাত লক্ষাধিক সমর্থক অংশ নিয়েছিল। যখন সরকারের প্রধান নেতা আধিপত্য প্রদর্শনের জন্য ছবির অনুমোদন দেন সেটি কেমন হবে, এ ছবি তারই আরেক উদাহরণ।
বিতর্কের মধ্যেই চলতি মাসের মাঝামাঝিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' ছবির অনুমোদন দিয়েছেন। বিজেপি যেভাবে ভারত ও দেশের বাইরে ছবিটি প্রদর্শনে অর্থায়ন করেছে, তার মানে ভারতে সন্দেহাতীতভাবেই তারা মুসলিমবিরোধী অবস্থান তৈরি করতে চায়। ইতোমধ্যে ছবিটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণায় আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, ভারতীয়দের এ ছবিটি দেখতে হবে যদি তারা ভবিষ্যতের ব্যাপারে আগ্রহী হয়।
ক্ষমতাসীন অভিজাতরা সিনেমা শিল্পকে সব সময়ই যে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে পেরেছে, তা নয়। সত্তরের দশকে ভারতে জরুরি অবস্থার
সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন ওই সময়কার খ্যাতিমান শিল্পী কিশোর কুমারকে সরকারের ২০ দফা পরিকল্পনা প্রচারের কথা বলেছিলেন, কিশোর তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে হিন্দি সিনেমা শিল্প অনেক
বদলে গেছে। 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' ছবিতে কাশ্মীরিদের যেভাবে রক্তপিপাসু হত্যাকারী হিসেবে দেখানো
হয়েছে, এর মাধ্যমে কার্যত তাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
২০১১ সালে বলিউডের ৫০টি ছবির ওপর পরিচালিত গবেষণায় বেরিয়েছে, এর প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ ছবিতেই মুসলমানদের 'অনাকাঙ্ক্ষিত' চরিত্রে উপস্থাপনা করা হয়েছে। ওই গবেষণার প্রাপ্ত ফলে আশি ও নব্বই দশকের শেষ ভাগের কয়েকটি ছবির উল্লেখ রয়েছে, যেগুলোতে মুসলমানদের অপরাধী বা খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
দ্য কাশ্মীর ফাইলসের উপসংহার হিসেবে সিনেমা হলের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া উল্লেখ্যযোগ্য, যেখানে দক্ষিণপন্থি হিন্দুরা এ বলে হিন্দু পুরুষদের আহ্বান জানিয়েছে যে, তাদের উচিত জোরপূর্বক মুসলিম নারীদের বিয়ে
করে সন্তান উৎপাদন করা, যাতে তাদের সংখ্যা মুসলিমদেরও ছাড়িয়ে যায়। এ থেকে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এমন বিভীষিকাময় দিনগুলো হয়তো আর বেশি দূরে নেই।
ফয়সাল হানিফ :মিডিয়া মনিটরিং এনালিস্ট, সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং, ইংল্যান্ড; মিডল ইস্ট আই থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।