Mahfuzur Rahman Manik
সিনেমা নয়, সত্যি
মার্চ 25, 2022

বিয়ে-সংসার নিয়ে মানুষের যে স্বপ্ন থাকে; ফাহমিদা কামালেরও নিশ্চয় ব্যতিক্রম ছিল না। তার বিয়েও হয়েছে। তবে তা স্বাভাবিক পরিবেশে নয়। মেয়েটিও স্বাভাবিক ছিল না। অসুস্থতার মধ্যেই তার বিয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়। নাকে অক্সিজেনের নল, পরনে বিয়ের লাল বেনারসি, পাশে বর- এমন ছবি তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। স্বাভাবিকভাবেই সবাই নবদম্পতিকে অভিনন্দন জানান এবং ফাহমিদার দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। বলা বাহুল্য, ফাহমিদা মনের জোরে বিয়ের পরদিন বাসায়ও ফিরেছিলেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতির ফলে পরদিনই তাকে ফিরতে হয় হাসপাতালে। অবশেষে বিয়ের ১২তম দিনে ২১ মার্চ মেয়েটি চিরদিনের জন্য চলে যায়।

ফাহমিদার মৃত্যুর খবর নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাপিয়ে মূলধারায়ও খবরটি প্রকাশ পায়। এভাবে মানুষের চোখে জল আনা ফাহমিদার গল্পটা অসমাপ্তই থেকে গেল। মেয়েটি চলে গেলেও তার আলোচনা থেমে থাকেনি। বস্তুত তার জীবনে যা ঘটেছে, এমনটি আমরা সিনেমার পর্দায় দেখতে অভ্যস্ত। ফাহমিদার ঘটনা যেন সিনেমাকেও ছাড়িয়ে গেছে!

ফাহমিদার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছিল। তার বয়স ৩০ না পেরোলেও ব্যাধি তাকে ভালোভাবেই কাবু করে ফেলেছিল। তার পরও পরিবারের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার সব ধরনের চেষ্টা করা হয়। দেশের চিকিৎসার পাশাপাশি ভারতেও নেওয়া হয়েছিল ফাহমিদাকে। তার পরও মেয়েটিকে রাখা যায়নি।

ফাহমিদার বিয়ের ঘটনাটি অনেককেই আলোড়িত করেছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল এবং তার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। এমনকি ফাহমিদা রাজি না থাকলেও ৯ মার্চ হাসপাতালের শয্যাতেই প্রিয়তমাকে বিয়ে করেন মাহমুদুল হাসান। তারা নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছিলেন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে নতুন করে সংসার শুরু করবেন। স্ত্রীর এমন মৃত্যু স্বামী মাহমুদুল হাসানের জন্য বড় আঘাত বটে।

স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের মৃত্যু ঘটে। তারপরও মানুষ শোকাহত হয়। প্রিয় মানুষ যখন চলে যায়, কেউ হাউমাউ করে কাঁদে। কেউ অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথা মানুষকে বেদনাহত করে। সামাজিক মানুষ হিসেবে স্ত্রী, ভাই, বন্ধু, মা-বাবা, সন্তান ইত্যাদি সম্পর্কের যে গভীরতা ও নিবিড়তা, তা স্বাভাবিক বা প্রাত্যহিক চলাফেরায় বোঝা না গেলেও যখন কেউ দূরে যায় তখনই তা বোঝা যায়। কাছে থাকলে অনেক সময় মান-অভিমান হলেও দিন শেষে ওই সম্পর্কের গুরুত্বটা আমরা অনুভব করি। সন্তানদের ভালো রাখার জন্য মা-বাবার ত্যাগ; স্ত্রী-পরিবারের জন্য স্বামীর পরিশ্রম; ভাইবোনের খুনসুটি; বন্ধুত্বের টান ইত্যাদি প্রতিটি সম্পর্কের গল্প আলাদা। তবে বিয়ের মধ্য দিয়ে যে সম্পর্কের বীজ বোনা হয় এবং যে বন্ধন তৈরি হয়, তার গভীরতা, উচ্চতা ও বিস্তৃতি বিস্ময়কর। ফাহমিদা ও মাহমুদুল হাসান উভয়েই হয়তো ভেবেছিলেন, সুস্থ হলে স্বাভাবিক সংসার-জীবন যাপন করবেন। তাদের সন্তান হবে। তারা বড় হবে। দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানি হওয়ার স্বপ্ন দেখাও বিস্ময়কর নয়। কারণ বিয়ের বিষয়টি সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদি এক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই হাসপাতালে ফাহমিদার যখন বিয়ে হয়েছে, তা আমাদের অবাক করেছে। বিশেষ করে, স্বামী হিসেবে মাহমুদুলের প্রশংসা করেছেন। অনেকেই ভালোবাসার গভীরতাও বোঝার চেষ্টা করেছেন। এমন পরিস্থিতিতেও বিয়ে সম্ভব!

মানুষের জীবন সরলরৈখিক নয়। এখানে নদীর জোয়ার-ভাটার মতো উত্থান আছে, পতন আছে। কিন্তু জীবনের ধর্ম থেমে থাকা নয়। জীবন যাপনের অংশ হিসেবেই মানুষ স্বপ্ন দেখে। এ স্বপ্নই বোধ হয় বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় প্রেরণা। মানুষ যত কষ্টেই থাক; ভাবে, একদিন তার অবস্থার পরিবর্তন হবে। দরিদ্র ভিক্ষুকও হয়তো বলবে, একদিন তার অনেক টাকা হবে। হাসপাতালে থাকা রোগীও সুস্থ হয়ে বাড়ি গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখেন। ফাহমিদা হাসপাতালে থেকেই বিয়ে করেছেন। তাদের গল্প সেখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু নিয়তি! গল্প অসমাপ্ত রেখেই মেয়েটির অন্য ভুবনে পদার্পণ। আমাদের জীবনের গল্পও হয়তো শেষ হবে না। অসমাপ্ত রেখে যাওয়ার মানসিকতা নিয়ে তাই চলতে হবে।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।