Mahfuzur Rahman Manik
কর্ণাটকে হিজাব বিতর্কের রাজনৈতিক সমীকরণ
ফেব্রুয়ারী 11, 2022

মূল লেখক : অরুণ দেব
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

ভারতের কর্ণাটকে অন্তত পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব পরিধানে 'বাধা' দেওয়ার বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। মঙ্গলবার এ বিষয়ে হাইকোর্টে শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। একজন শিক্ষার্থী বিষয়টি নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে, যাকে ক্লাস করতে দেওয়া হয়নি। ভারতের সংবিধানের ১৪ থেকে ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিক হিসেবে ধর্মীয় অধিকার দেওয়া আছে। মুসলিম মেয়েরা মাথায় যে স্কার্ফ বা হিজাব পরিধান করে থাকে, সংশ্নিষ্ট অনুচ্ছেদে তার অনুমোদনও সেখানে মিলছে।

হিজাব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি এবং এ ক্ষেত্রে কর্ণাটকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার পেছনে রাজনীতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে আগামী বছর কর্ণাটকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রথম ঘটনা হিসেবে ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর কর্ণাটকের উদুপি জেলায় সরকারি পিইউ কলেজে হিজাবে বাধা দেওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। এভাবে একে একে মোট পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীদের প্রবেশে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে তিনটি সরকারি আর দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভয়াবহ উপস্থিতি আমরা দেখছি। হিজাবের বিষয়টি সামনে রেখে সেখানে ভোটব্যাংক গড়ার অপচেষ্টা চলছে। কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং ভারতের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া; সব সংগঠন এ ঘটনায় একে অপরকে দোষারোপ করছে। এর মধ্যে শুক্রবার কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসভরাজ বোমাই সেখানকার শিক্ষামন্ত্রী বিসি নাগেস ও সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

কর্ণাটকে হিজাব বিতর্কের রাজনৈতিক সমীকরণ বুঝতে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখা প্রয়োজন। গত বছরের অক্টোবরে সরকারি পিইউ কলেজে কিছু মুসলিম শিক্ষার্থীর ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া-সিএফআইর ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি একটি কলেজের হলেও এটি ছড়িয়ে পড়ার কারণে জেলা হয়ে রাজ্যেও আলোচিত হয়। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মনে করা হচ্ছে, কংগ্রেসের মুসলিম ভোটব্যাংক সিএফআই নিয়ে নিচ্ছে। ক্ষমতাসীন বিজেপিও বিষয়টি ভালোভাবে দেখেনি। যার ফলে আমরা দেখছি, যে তিনটি সরকারি কলেজে হিজাব পরা শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, সেখানে দাপ্তরিক কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও কথা বলেছেন কর্ণাটক সংসদের সদস্য রঘুপতি ভাট। আর কুন্দাপুরের দুটি কলেজের ব্যাপারে কথা বলেছেন বিজেপির কর্ণাটক সংসদ সদস্য হালাদি শ্রীনিবাস শেঠি। বিজেপির স্থানীয় এক নেতা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের বক্তব্য দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ তারা কলেজ উন্নয়ন কমিটির সদস্য। তিনিও স্বীকার করেছেন, হিজাব বিতর্ক তার দলের জন্য রাজনৈতিক বিষয়।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, হিজাব বিতর্কে ভাটের অন্তর্ভুক্তির গভীর তাৎপর্য রয়েছে। তিনি এক কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৩ সালে নির্বাচনে বিজেপির টিকিট পেতে ব্যর্থ হন। ২০১৮ সালে বিজেপির টিকিট পেয়েছেন, তাও দেরিতে। বিজেপি সূত্রে জানা যায়, সেখানে তারা আরেকজন উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। ওই সময় উপযুক্ত প্রার্থীর অভাবেই ভাট মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ভাট তাই হিজাব বিতর্ক কাজে লাগাতে চাইছেন। যার মাধ্যমে তিনি বিজেপির শক্তিশালী প্রার্থী হতে চান।

কংগ্রেস যদিও প্রাথমিকভাবে বিষয়টির প্রতিক্রিয়ায় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিল, কিন্তু যখনই একাধিক কলেজে হিজাব পরতে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটে, তখন কংগ্রেসের নেতা এবং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারাইয়া বলেছেন, হিজাব মুসলিম মৌলিক অধিকার। তিনি আরও বলেছেন, আমরা দেখব কীভাবে এ ঘটনা হিন্দু ভোটব্যাংকে কাজে লাগবে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বিষয়টি নিয়ে টুইট করেছেন, 'শিক্ষার্থীদের হিজাব তাদের শিক্ষার পথে বাধা হতে দিয়ে আমরা ভারতের মেয়েদের ভবিষ্যৎ কেড়ে নিচ্ছি। মা সরস্বতী সবাইকে জ্ঞান দান করেন। তিনি পার্থক্য করেন না।' বলাবাহুল্য, হিজাব বিতর্ক কর্ণাটকে কংগ্রেসের সুযোগেও প্রভাব ফেলবে। কারণ আমরা জানি, উপকূলীয় কর্ণাটকে বস্তুত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাবই বেশি।
দিল্লিতে রাষ্ট্রীয় দিবসের প্যারেডে সামাজ সংস্কারক শ্রী নারায়ণ গুরুর মূকাভিনয় করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে সরকারের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা বি জনার্ধন পূজারি ২৬ জানুয়ারি বেঙ্গালুরুতে একটি প্রতিবাদী শোভাযাত্রা করেন। কর্ণাটকের দুটি জেলা দক্ষিণা কান্নাডা ও উদুপির পূজারির বিল্লাভা জনগোষ্ঠী এ ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা কোনোভাবেই মূকাভিনয় বাদ দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। এসব জেলায় আধ্যাত্মিক গুরুর উল্লেখযোগ্য ভক্ত রয়েছে। বস্তুত এর মাধ্যমে কংগ্রেস এ অঞ্চলের ধর্মীয় রাজনীতির পরিচয় পরিবর্তন করে জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তিতে ভোটের চেষ্টা করছে। তারা জানত, বিল্লাভা বা মোগাভিরা জনগোষ্ঠী যদি হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তিতে ভোট প্রদান করে, তাতে কংগ্রেস লাভবান হবে। কারণ অঞ্চলে এ দুটি জনগোষ্ঠীর বড় ভোটব্যাংক রয়েছে। তবে হিজাব বিতর্ক সে সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে। যেহেতু এখন বিতর্কের বিষয় হিন্দু বনাম মুসলিম।

মঙ্গলবার হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব বিতর্কের বিষয়টি সেখানকার নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়।

অরুণ দেব: ভারতীয় সাংবাদিক; হিন্দুস্তান টাইমস থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।