Mahfuzur Rahman Manik
মাওলানা আজাদ : শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক
ফেব্রুয়ারী 26, 2021

শিক্ষা বিস্তারে উজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণে রেখে প্রতি বছর মাওলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিন (১১ নভেম্বর) সমগ্র ভারতে 'জাতীয় শিক্ষা দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। যদিও মাওলানা আজাদের খ্যাতি শিক্ষার চেয়েও রাজনীতিতে বিস্তৃত হয়েছে বেশি। তিনি আত্মজীবনী গ্রন্থ 'ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম'-এর উৎসর্গে লিখেছেন 'ফর জওহরলাল নেহরু ফ্রেন্ড অ্যান্ড কমরেড'। বলাবাহুল্য, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ও স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে কেবল তার বন্ধুত্বের সম্পর্কই ছিল না, একই সঙ্গে উভয়ই ছিলেন একই আন্দোলনের সহযোদ্ধা। এমনকি নেহরুর মন্ত্রিসভার মন্ত্রীও ছিলেন তিনি। স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ।

আনন্দবাজার পত্রিকা তার অবয়ব এভাবে বর্ণনা করেছে, 'ছিপছিপে চেহারায় রোদচশমা চোখে, কালো টুপি আর ধোপদুরস্ত পোশাক'। আমরা তাকে দেখি মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। তিনি ১৯১৯ সালে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে মাহাত্মা গান্ধীর অহিংস মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলন সংঘটনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৩ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মাওলানা আজাদ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে সভাপতি নির্বাচিত হন।

মাওলানা আজাদের সাংবাদিকতা, লেখালেখি ও রাজনীতি সমানতালে চলেছে। এর মধ্যেও তিনি শিক্ষাচিন্তা সযতনে লালন করেছেন। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার ফ্রাইডে রিভিউতে 'মাওলানা অ্যান্ড মাও' শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বলা হয় মহাত্মা গান্ধী মাওলানা আজাদকে 'দ্য এম্পেরোর অব লানির্ং' বলে জ্ঞানের দিক থেকে প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও পিথাগোরাসের সমমর্যাদার ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

মাওলানা আজাদ ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে কেবল ভারতের অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্যনীতি গঠনেই ভূমিকা রাখেননি, একই সঙ্গে নারী ও পিছিয়ে পড়া ভারতীয়দের সামাজিক অধিকার ও অর্থনৈতিক সুবিধাদি দেওয়ার পক্ষেও কাজ করেছেন। মাওলানা আজাদ ১৯৪৯ সালে সবার জন্য মৌলিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার কথা বলেছেন এবং সেটি যে গণতান্ত্রিক ভারতের স্বার্থে জরুরি, সে যুক্তিও দেন। ৬০ বছর পর তারই পথ ধরে ২০০৯ সালে এসে আমরা দেখেছি, ভারত শিশুদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা অ্যাক্ট পাস করে। নীতিগতভাবে মাওলানা আজাদ শিক্ষায় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেছেন- নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সর্বজনীন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, বয়স্কদের নিরক্ষরতা দূর করতে সামাজিক শিক্ষার প্রচলন করা, শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা, একই সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় সুবিধা বৃদ্ধি করা, জাতির প্রয়োজনে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার এবং সাংস্কৃতিক জীবন সমৃদ্ধ করতে কলা ও বিনোদনে জোর দেওয়া। কেবল ভারতই নয়, মাওলানা আজাদের শিক্ষা দর্শন অন্যান্য দেশেও বাস্তবায়ন হয়েছে। বাংলাদেশেই সাংবিধানিকভাবে সার্বজনীন শিক্ষা বাধ্যতামূলক। তার দর্শন অনুসারে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় জোর দিলে আমাদের বেকার সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতো। আমরা দেখেছি, মাওলানা আজাদ কেবল স্বপ্টম্নই দেখাননি, বাস্তবায়নও করেছেন অনেক কিছু। ভারতে শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে তার অবদান স্বীকার করতেই হবে। এর মধ্যে রয়েছে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অব টেকনিক্যাল এডুকেশন, সাহিত্য একাডেমি ও সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অন্যতম। অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনস্ক মাওলানা আজাদ সবাইকে নিয়ে একটি 'ইনক্লুসিভ' সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তার রচিত আল কোরআনের তাফসির 'তর্জুমানুল কুরআনে'ও সেই ছাপ আমরা দেখেছি। উর্দু ভাষায় রচিত তার এ তাফসির গ্রন্থটি তিন খণ্ডে বেরিয়েছে। তিনি কোরআনের শব্দগুলো ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন তার 'মূল' অর্থ কী। তার তাফসির বিজ্ঞ মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

মাওলানা আজাদ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে ১৯২০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যেমন কয়েকবার জেল খেটেছেন, তেমনি তার কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তার সম্মানে ভারতে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। নয়াদিল্লিতে মাওলানা আজাদ মেডিকেল কলেজ, ভুপালে মাওলানা আজাদ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, কলকাতায় মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অন্যতম। ১৯৯২ সালের ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক 'ভারতরত্ন' অর্জনকারী মাওলানা আজাদের জীবন অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে ১৯৫৮ সালে।

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।