Mahfuzur Rahman Manik
শিক্ষার্থীর সুযোগ সংকোচন কেন
জানুয়ারী 10, 2021

শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা করোনা দুর্যোগে সৃষ্ট প্রভাব অটোপাস-অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে কোনো রকম কাটিয়ে উঠতে পারলেও উচ্চশিক্ষা এখনও বলা চলে পিছিয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল স্নম্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা সম্পন্নের আয়োজন করছে। অন্যান্য বর্ষের ব্যাপারে প্রশাসন এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এ সপ্তাহের মধ্যেই উচ্চ মাধ্যমিকের (অটোপাসের) ফল প্রকাশ হবে। এরপরই উচ্চশিক্ষায় ভর্তির তোড়জোড় শুরু হবে। ভর্তির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবশ্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তিতে সম্মত হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আগে থেকেই স্বতন্ত্রভাবে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেছে। সবাই গুচ্ছ পদ্ধতিতে এলে অন্তত করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতো। তারপরও অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এ পদ্ধতিতে যাচ্ছে- এটা ভালো বিষয়। কিন্তু স্বস্তি মিলছে না; বিভাগ পরিবর্তনের বিষয়ে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে।

করোনা থেকে সুরক্ষা দিতে প্রশাসন পরীক্ষা কমানোর সিদ্ধান্ত নিলেও বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ হলে শিক্ষার্থীরা দুর্যোগ উপেক্ষা করেই মাঠে নেমেছে? আগে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য তথা বিজ্ঞান বিভাগ, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থীরা নিজস্ব বিভাগে ভর্তি হতে না পারলেও বিভাগ পরিবর্তনের নির্দিষ্ট ইউনিটে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শর্তসাপেক্ষে অন্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিল। এ বছর গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির ক্ষেত্রে এ রকম পৃথক কোনো ইউনিট রাখা হয়নি। ভর্তিচ্ছুরা বিভাগ পরিবর্তনের জন্য আলাদা পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখার দাবি জানিয়েছে। এই দাবিতে রাজধানী ঢাকা, বরিশাল শহরসহ বেশ কিছু জায়গায় তারা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।

আমরা জানি না, কোন যুক্তিতে বিভাগ পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের পরীক্ষা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসছে। এটা ঠিক যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও বিভাগভিত্তিক পরীক্ষার কথা বলে প্রথমে 'চ' ও 'ঘ' ইউনিট বাদ দেওয়ার আলোচনা করে। পরে চারুকলা ইউনিটের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার্থে 'চ' ইউনিট রাখলেও 'ঘ' ইউনিট এখনও পর্যালোচনার 'আশ্বাসে' রয়েছে। আমরা মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও যেহেতু একবারই ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে, সেহেতু 'ঘ' ইউনিটের মাধ্যমে শিক্ষার্থী যাতে অন্য বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায়- সে ব্যবস্থা রাখতেই হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ঘ' ইউনিট কিংবা গুচ্ছ পদ্ধতিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ পরিবর্তনের জন্য আলাদা পরীক্ষা নেওয়া জরুরি নানা কারণেই। একদিকে এ বছর অটোপাসের মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিকে সবাই কৃতকার্য হবে বলে অন্যান্যবারের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর জন্য অধিক ভর্তির পথ প্রশস্ত করতে পারে বিভাগ পরিবর্তন। বলা হচ্ছে, নিজ নিজ বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীরা বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ পাবে। কিন্তু এ যুক্তি দুটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমত, এটি অধিক জটিলতার সৃষ্টি করবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগের সংকোচন করবে। কোনো শিক্ষার্থী যদি তার নিজের বিভাগের পরীক্ষায় ভালো করতে না পারে কিংবা অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে অংশগ্রহণ করতে না পারে তার জন্য বিভাগ পরিবর্তনের পরীক্ষাটি কেবল সুযোগই নয় বরং অধিকারও বটে। শিক্ষার্থীরা যে অধিকার এত দীর্ঘদিন ধরে পেয়ে আসছে, সেটি হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া অমানবিক সিদ্ধান্তও বটে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, আগে শিক্ষার্থীদের হাতে অধিক সুযোগ থাকত। সে চাইলে ১৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিতে অংশ নিতে পারত। তখন একটায় না হলে অন্য বিকল্প তার হাতে থাকত। এখন সেই বিকল্প নেই বলেই অন্তত দ্বিতীয় সুযোগ হিসাবে বিভাগ পরিবর্তনের জন্য আলাদা পরীক্ষা জরুরি।

গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিভাগ পরিবর্তনের জন্য আলাদা পরীক্ষা নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য খুব বেশি ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। এ পরীক্ষার সঙ্গে সব শিক্ষার্থীর স্বার্থ জড়িত বলে অধিকাংশই বিভাগ পরিবর্তনে আবেদন করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, যেখানে গত ২০১৯-২০ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়টির 'খ' ও 'গ' ইউনিটে যথাক্রমে ৪৫ হাজার ও প্রায় ২৯ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করে, সেখানে বিভাগ পরিবর্তনের 'ঘ' ইউনিটে আবেদন পড়ে সাড়ে ৯৭ হাজার। সুতরাং আয়ের কথা বলছি না বরং শিক্ষার্থীর স্বার্থেই বিভাগ পরিবর্তনে আলাদা ইউনিটে ভর্তি নেওয়া আবশ্যক।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেমন ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে, তেমনি অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা গ্রহণের চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ক্ষেত্রে স্নাতক শেষ বর্ষ ও মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করা জরুরি। কারণ একদিকে শিক্ষার্থীরা অনেক দিন বসে আছে। করোনা পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে অনেকেরই এতদিনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হয়ে যেত। তারচেয়ে বড় কথা, পিএসসি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। স্বাভাবিক সময় হলে যারা আবেদন করতে পারত, এখনও তারা যাতে বঞ্চিত না হয় সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শেষ বর্ষ কিংবা মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা নিতে হবে। ইতোমধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য আন্দোলনও করেছে। আমরা দেখেছি, ১৩ ডিসেম্বর ইউজিসির বৈঠকে এসব পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আগেই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পরীক্ষা গ্রহণের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আমরা বিস্মিত যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেও হল বন্ধ রাখার কথা বলছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি পরীক্ষা হবে, অথচ হল খোলা থাকবে না- এরকম অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে গ্রহণ করছে!

শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বিভাগ পরিবর্তনে আলাদা পরীক্ষার জন্য যেমন আন্দোলন করছে, তেমনি হল খুলে দেওয়ার জন্য বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন ধরেই আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলন চলছে, সব ছাত্র সংগঠন হল খোলার দাবি জানিয়েছে। শিক্ষার্থীদের উভয় দাবিই যৌক্তিক। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে দাবিগুলো ভালোভাবেই বিবেচনা করতে হবে। বিভাগ পরিবর্তনের এ সংকট নতুন করে সৃষ্টি করে তা জিইয়ে না রেখে সমাধানের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থী উভয়েরই কল্যাণ রয়েছে। শিক্ষার্থীর দুর্ভোগ লাঘবে অনেক দিনের আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় যে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তিতে যাচ্ছে- একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে এ মহৎ উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। একই সঙ্গে করোনায় গ্রামগঞ্জে থাকা শিক্ষার্থী, যাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খুলে না দিলে তারা কীভাবে ক্যাম্পাসে এসে স্নাতক শেষ বর্ষ কিংবা মাস্টার্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় অংশ নেবে?

করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট পরিপকস্ফস্ফ। প্রয়োজনীয় সতর্কতা মানার ওপর জোর দিয়ে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষা সংকুচিত করা যৌক্তিক হবে না। আবাসিক হল বন্ধ রেখে সশরীরে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার্থীদের 'বিপদে' ফেলার কাজও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিশ্চয় করবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখুক।

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।