Mahfuzur Rahman Manik
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম চাইতেন-আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আগস্ট 24, 2020

সাক্ষাৎকার

লেখক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো'-এর রচয়িতা। ১৯৫০-এর দশকে সাংবাদিকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। পেশাগত কাজে সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, ইউনেস্কো পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মানিক মিয়া পদকসহ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে লন্ডনপ্রবাসী আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালে বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর সংবাদমাধ্যম ভাবনা প্রসঙ্গে সমকালের সঙ্গে কথা বলেন


সমকাল : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার কবে প্রথম দেখা হয়?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে বরিশালে। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ১১ মার্চ রাষ্ট্র্রভাষা দিবস পালন করা হতো। ছাত্রলীগ তখন দ্বিধাবিভক্ত ছিল। একটি মুসলিম লীগ সরকারের সমর্থক। নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। অন্যটির নেতা মুসলিম লীগ অর্থাৎ তখনকার সরকারবিরোধী ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তখনও আওয়ামী লীগের জন্ম হয়নি। বরিশালে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগের স্ট্রং হোল্ড ছিল। নেতা ছিলেন মহিউদ্দীন আহমদ (পরে ন্যাপ এবং আরও পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন)। তিনি শাহ আজিজের ব্যক্তিগত বন্ধুও ছিলেন। বরিশালে ১১ মার্চের ভাষা দিবস উদযাপনের বিরাট ব্যবস্থ্থা হয়। শাহ আজিজ তা জানতে পেরে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগ যাতে সেই দিবস পালনে যোগ না দেয়, সেই ব্যবস্থ্থা করার জন্য বরিশালে আসেন। শাহ আজিজ বরিশাল থেকে চলে যান ৭ মার্চ (১৯৪৯)। যতদূর মনে পড়ে, শেখ মুজিব মার্চ মাসের ৮ কি ৯ তারিখে বরিশালে আসেন। তখন তিনি বঙ্গবন্ধু নন। ছিলেন মুজিব ভাই। বরিশালে মুজিব অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন বাহাউদ্দীন আহমদ এবং শামসুল হক চৌধুরী টেনু মিয়া। বিএম কলেজের একটি হলে শাহ আজিজের বক্তব্য খণ্ডন করে এবং বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো ভাষায় বক্তৃতা দেন মুজিব ভাই। আমি তার বক্তৃতা বরিশালের সাপ্তাহিক নকীব পত্রিকায় ছেপেছিলাম। মুজিব ভাই তাতে খুশি হয়েছিলেন। তার সঙ্গে এই প্রথম আমার পরিচয়। আমি তখন স্কুলে পড়ি। বঙ্গবন্ধু আমাকে ম্যাট্রিকের পর ঢাকা যেতে বলেন।

সমকাল : সাংবাদিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কেমন সম্পর্ক ছিল?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সমাদর করতেন। সে সময়ের প্রায় প্রতিটি তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। এমনকি যারা তার সমালোচনা করতেন কিংবা বিরোধী পত্রিকায় কাজ করতেন তাদের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধু খারাপ ব্যবহার করেননি। যেমন এবিএম মূসা অবজারভার পত্রিকায় কাজ করতেন। তার শ্বশুর ছিলেন আওয়ামী লীগ বিরোধী পত্রিকা তখনকার পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক। তারপরও মূসার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভালো সম্পর্ক ছিল। এমনকি আমরা দেখেছি, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন, তিনি ফেনী থেকে নির্বাচিত হন। এমনকি যে তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে নিয়ে এত সমালোচনা, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সাংবাদিক। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করতেন। তাহের উদ্দিন ঠাকুরকেও বঙ্গবন্ধু মনোনয়ন দিয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদের তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু নিজেই তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতেন। বিরাট রুমে তাহের উদ্দিন ঠাকুর বসতেন।

শহীদুল হক নামে পাকিস্তান অবজারভারের এক সাংবাদিক ছিলেন। যাকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন কিনা আমি জানি না। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন ওই সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর কাছে যান, সবাই বলাবলি করছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুবিরোধী ছিলেন। তাকে আসতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের বাধা দিলেন। ওই সাংবাদিক যখন এলেন বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং ক্ষমা করে দেন।

এভাবে ফয়েজ আহমদসহ অনেক সাংবাদিকের কথা বলতে পারব। এর দ্বারাই বোঝা যায় সাংবাদিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কেমন সম্পর্ক ছিল।

সমকাল : সাংবাদিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনি সফর করেছেন...

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজেরিয়া সফরের স্মৃতি আমার এখনও জ্বলজ্বলে। সেটা ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ ৭৩ জাতি শীর্ষ সম্মেলন চলছে। তার সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে আমি এবং বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক ওবায়দুল হক এ দু'জন ছিলাম। বলা চলে বাংলাদেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। একটি স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একজন গণতান্ত্রিক নেতা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন, সেই নেতাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন শীর্ষ সম্মেলনে আগত অন্যান্য নেতা।

বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কক্ষে ঢুকতেই অনেক নেতা তার দিকে ছুটে আসেন। আমার সাংবাদিক জীবনের এটা সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের তখন চা-বিরতি হয়েছে। রাষ্ট্রনায়করা একটা বিরাট হলঘরে পানীয় হাতে পরস্পরের সঙ্গে গল্প করছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে তাদের কয়েকজন গোল হয়ে দাঁড়ালেন। ভারতের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এগিয়ে এসে সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মিসরের আনোয়ার সাদাত, লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফি, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো ও কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো। এবং এ বৃত্তের বাইরে, একটু বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সৌদি আরবের কিং ফয়সাল। সম্ভবত আরও দু-একজন ছিলেন। তাদের কথা মনে নেই। তখনকার একটা বিষয় মনে পড়ে। সম্মেলনে অ্যালফাবেটিক্যালি বিশ্বনেতাদের বক্তৃতা দেওয়ার কথা। সে হিসেবে আফগানিস্তান আমাদের আগে। কিন্তু আফগান নেতা সম্মান করে বঙ্গবন্ধুকে তার আগে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সে সময় আলজেরিয়ার বিখ্যাত মসজিদ গ্র্যান্ড মসজিদে বঙ্গবন্ধু, আনোয়ার সাদাত, কিং ফয়সাল দল বেঁধে নামাজ পড়তে যেতেন। আর কোনো মুসলিম রাষ্ট্রনায়ক যেতেন না।

সমকাল : বঙ্গবন্ধু কেমন সংবাদমাধ্যম দেখতে চাইতেন?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম দেখতে চাইতেন। তিনি গঠনমূলক সমালোচনা সাদরে গ্রহণ করতেন। তবে সেটা যাতে প্রপাগান্ডামূলক না হয়। বঙ্গবন্ধু চাইতেন সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করুক। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সমালোচনা যেমন তিনি গ্রহণ করতেন তেমনি তিনি চাইতেন প্রয়োজনে মালিকের সমালোচনাও যেন সাংবাদিকরা করেন। অর্থাৎ সাংবাদিকরা যেন বিক্রি না হয়ে যান। তারা যেন সরকার ও মালিকের আধিপত্যমুক্ত হন। বাকশাল হওয়ার পর চারটি সংবাদপত্র ছিল। বঙ্গবন্ধু চাইতেন এ সংবাদমাধ্যমগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করুক।

এ প্রসঙ্গে সে সময়ের একটি ঘটনা। ১৯৭৫ সালের সম্ভবত জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে তখন একটি সংবাদপত্র বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু পছন্দ করেননি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনাদের ওপর জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে। কারও ব্যক্তিগত বিয়ে নিয়ে নয়।

সমকাল : বঙ্গবন্ধুর সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস আপনি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পত্রিকা পড়তেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে পত্রিকা পড়তেন আমার সন্দেহ, বর্তমান মন্ত্রী-এমপিরা সেভাবে পত্রিকা পড়েন কিনা। এক মন্ত্রী আমাকে বললেন, তিনি নাকি আমার সব লেখা পড়েন। তো তাকে আমি শিরোনামের কথা বলতে বললাম, তিনি বলতে পারলেন না। আমার লেখায় সাধারণ পাঠকের প্রতিক্রিয়া পেলেও আমি এমপি-মন্ত্রীদের তেমন পাই না। অথচ বঙ্গবন্ধুর পত্রিকা পড়ার দারুণ অভ্যাস আমি তাকে জেলে থাকতেও দেখেছি। আমার লেখার বিষয়েও বঙ্গবন্ধু বলতেন। বলতেন, তোর লেখা পড়েছি।

সমকাল : বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিকতা নিয়ে আপনি লিখেছেন...

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : হ্যাঁ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে সাংবাদিকতাও করেছেন। ১৯৪৫-৪৬ সালের দিকে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল হাশেম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ 'সাপ্তাহিক মিল্লাত' নামে একটি কাগজ বের করে। এই কাগজের প্রধান সম্পাদক ছিলেন আবুল হাশেম এবং সম্পাদক ছিলেন কাজী মোহাম্মদ ইদরিস। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের কিছু আগে বিখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টি ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, তখন হাশেম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের উদ্যোগে দৈনিক ইত্তেহাদ বের হয় কলকাতা থেকে। ১৯৯ পার্ক স্ট্রিটে ছিল ইত্তেহাদ অফিস। আবুল মনসুর আহমদ হন সম্পাদক। পত্রিকাটি তরুণ প্রজন্মের বাঙালি মুসলমান পাঠকদের মধ্যে বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করে। আবুল মনসুর আহমদের দৃষ্টি ছিল প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের দিকে। তিনি তাদের সাংবাদিকতার দিকে টানতে চেয়েছেন। তিনি দৃষ্টি দিয়েছিলেন শেখ মুজিব ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার (পরবর্তীকালে ঢাকায় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) দিকে। মানিক মিয়া চাকরি নিয়েছিলেন ইত্তেহাদের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইত্তেহাদে দু-চার কলম লিখতেন। তিনি তাকে সাংবাদিক হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। শেখ মুজিবকেও উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন- মনসুর ভাই, মিল্লাতের মতো ইত্তেহাদেও আমি লিখব। কিন্তু সাংবাদিক হবো না। সাংবাদিকতা আমার নেশা। কিন্তু পেশা রাজনীতি। আমি রাজনীতিক হবো।

সমকাল : বঙ্গবন্ধু নিজে পত্রিকা বের করেছিলেন না?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : হ্যাঁ, ১৯৫৬ কি ১৯৫৭ সালে। নাম সাপ্তাহিক 'নতুন দিন'। তিনি নিজে ছিলেন প্রধান সম্পাদক এবং কবি জুলফিকার ছিলেন সম্পাদক। কবি জুলফিকার ছিলেন মুজিব ভাইয়ের রাজনীতির ঘনিষ্ঠ অনুসারী। পত্রিকাটি কিছুদিনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই সময় বঙ্গবন্ধু একটি আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের নাম 'দুই অর্থনীতির আন্দোলন'। তখন ঢাকার মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে দুই অর্থনীতির দাবিতে তিনি একটি সম্মেলন করেন। তাতে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদরা যোগ দিয়েছিলেন। এমনকি পাকিস্তানভক্ত অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনও যোগ দিয়েছিলেন। এই সভায় শেখ মুজিব বলেন, পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদিত পণ্যের কনজুমার মার্কেটে পরিণত করার চক্রান্ত করছেন। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়নের কোনো ব্যবস্থাই তারা করছেন না। এমনকি কৃষিব্যবস্থারও সংস্কার করছেন না। বঙ্গবন্ধু শুধু দুই অর্থনীতি নিয়ে বক্তৃতা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি তার সম্পাদিত নতুন দিন কাগজে ধারাবাহিকভাবে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন- দুই অর্থনীতি কেন? তার এই প্রবন্ধটি তখন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী মহলে সাড়া ফেলেছিল। বঙ্গবন্ধুর লেখনীশক্তির প্রমাণ পাই তার প্রকাশিত বইগুলো বিশেষ করে 'কারাগারের রোজনামচা'য়।

সমকাল : বঙ্গবন্ধু নিয়ে আপনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন 'পলাশী থেকে ধানমন্ডি'। 'পয়েট অব পলিটিক্সে'র কাজ সম্পন্ন করারও পরিকল্পনা করছেন।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে 'পলাশী থেকে ধানমন্ডি' চলচ্চিত্র নির্মাণ করি। আমি চেয়েছি বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। তাই ২০০৫ সাল থেকেই পরিকল্পনা করছি। ছবির নাম 'দ্য পয়েট অব পলিটিক্স' দিয়েছেন লন্ডনের এক সাংবাদিক। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে বলিউডের অমিতাভ বচ্চনকে রাখার বিষয়টি ভেবে রেখেছিলাম। আর পরিচালক হিসেবে গৌতম ঘোষকে নিতে চেয়েছিলাম। কলকাতায় গিয়ে তার সঙ্গে কথাও বলেছিলাম। অমিতাভকে তখনও প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। তার সঙ্গে যোগাযোগের আগেই দেখা গেল ছবির বাজেট প্রায় একশ' থেকে দেড়শ' কোটি টাকার মতো লাগছে। আমার পক্ষে এত টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। স্ট্ক্রিপ্ট তখনই পুরোটা লেখা হয়েছিল। সিনেমাটি করার আশা এখনও ছাড়িনি। আমি এখন স্থবির হয়ে গেছি। হাঁটাচলা করতে পারি না; হুইলচেয়ারে চলাফেরা করি। বেঁচে থাকলে সামনের বছর ছবির কাজ শেষ করব। ছবিটি পরিচালনা করবেন গৌতম ঘোষ। বঙ্গবন্ধুর ওপর সরকার একটি ছবির উদ্যোগ নিয়েছে। সেটা ভালো হবে বলেই আশা করছি।

সমকাল : আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপ্তি আপনি কীভাবে দেখেছেন?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অল্প সময়েই বঙ্গবন্ধু একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন। আলজেরিয়ার সম্মেলনের কথা আমি বলেছিলাম। মিসরের আনোয়ার সাদাত, সৌদি আরবের কিং ফয়সাল, লিবিয়ার গাদ্দাফি, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোসহ ৭৩ দেশের প্রতিনিধি সেখানে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কথা বলতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু সেই সন্দেহ তিনি কাটিয়ে এসেছিলেন। এটাই তার বড় বিশেষত্ব। সেখানে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন, যা শুনে ফিদেল কাস্ত্রো ছুটে এসে বঙ্গবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, 'আমি হিমালয় দেখিনি, আপনাকে দেখেছি। আমার আর হিমালয় দেখার দরকার নেই।' বঙ্গবন্ধু যে বড় লিডার, সেটা ওই সম্মেলনেই প্রমাণ হয়ে যায়।

সমকাল : তিনি জাতিসংঘে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেন।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রথম মুখপাত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতি একটি স্মরণীয় অধ্যায়। সর্বোচ্চ বিশ্ব ফোরামে তিনিই প্রথম উচ্চারণ করেন বাংলাদেশের নাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তখন অভিনন্দন আর আমন্ত্রণ। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য গোটা বিশ্বে বঙ্গবন্ধু অর্জন করেন বিশ্বনেতার সম্মান। বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য-সহায়তার জন্য সোভিয়েত জনগণকে ধন্যবাদ জানান। সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আদম মালিক, তাঞ্জানিয়ার জুলিয়াস নায়ারে প্রমুখ তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু খুব ভালো ইংরেজি জানতেন, সুন্দর ইংরেজি বলতেন। সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে তিনি ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার দেন।

সমকাল : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কখন আপনার শেষ  দেখা হয়?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : বঙ্গবন্ধুকে আমি শেষবার দেখি ১৯৭৫ সালের জুন মাসে। তখন জেলা গভর্নরদের ট্রেনিং দিচ্ছিলেন। আবার নতুন করে গভর্নমেন্ট (সরকার) হবে। আর তখনই আমি দেখে এসেছিলাম, বাংলাদেশে একটি ষড়যন্ত্রমূলক আবহাওয়া কাজ করছে। যেখানে যাই সেখানেই বলে একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হবে। খুবই গভীর ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু জানতেন কিনা জানি না। আমি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারতেন না, বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারে।

সমকাল : কষ্ট করে ফোনে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।