Mahfuzur Rahman Manik
খোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কতটা প্রস্তুত?
জুলাই 10, 2020
মাস্ক ব্যবহার, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্তকরণ কিংবা শরীরের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রস্তুতির পরিসর আরও বিস্তৃত

অধিকাংশ দেশেই করোনা সংক্রমণের কারণে বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে শুরু করেছে। সংক্রমণের মাত্রা অনুযায়ী কোথাও বেশি সময়, আবার কোথাও অল্প সময় শ্রেণি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। যেমন ডেনমার্কে ১১ মার্চ বন্ধ হওয়া স্কুল খুলেছে ২০ এপ্রিল। আর আমাদের ১৬ মার্চে বন্ধ হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী মাসের ৭ তারিখ। করোনা সংক্রমণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আরও পেছাতে পারে। তবে আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখনই খুলবে, তার আগে আমাদের কিছু প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। তার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কতটা প্রস্তুত?
প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যেসব দেশ ইতোমধ্যে স্কুল খুলেছে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। ২ জুলাই ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানে 'ব্যাক টু স্কুল : হোয়াট ক্যান পিউপিলস ইন ইংল্যান্ড এক্সপেক্ট ফ্রম সেপ্টেম্বর?' অর্থাৎ স্কুল খোলার ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা সেপ্টেম্বর থেকে কী আশা করতে পারে? শিরোনামের প্রতিবেদনে করোনা-পরবর্তী সেখানকার বিদ্যালয় খোলার নির্দেশনার বিস্তারিত এসেছে। জুন মাসের শুরু থেকেই সেখানে স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে। জুন মাসের খোলাটা ছিল আংশিক। এতদিন কেউ চাইলে তার সন্তানকে স্কুলে না পাঠিয়েও থাকতে পারত, তাদের জন্য বিকল্প অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা। কানাডাসহ অনেক দেশই এই শিথিলতা অনুমোদন দিয়েছে। কানাডা প্রবাসী তামান্না কলিম দ্যুতি জানিয়েছেন, জুনে সেখানেও স্কুল খুলেছে। মাসখানেক শ্রেণি কার্যক্রম চললেও তিনি তার মেয়েকে তখন স্কুলে পাঠাননি। গ্রীষ্ফ্মকালীন ছুটি কাটিয়ে সেপ্টেম্বরে আবার স্কুল খুললে তখন পাঠাতে নিরাপদ বোধ করবেন। আবার দক্ষিণ কোরিয়াসহ কিছু দেশে আগে বড়দের, তারপর ছোটদের এভাবে স্কুল খুলেছে। এতদিন যা-ই হয়েছে ইংল্যান্ডে কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে সশরীরে স্কুল করা বাধ্যতামূলক করেছে। কেউ স্কুলে না গেলে তার জন্য জরিমানার কথাও বলা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনার ঝুঁকি কমাতে প্রস্তুতিতে মাস্ক ব্যবহার, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্তকরণ কিংবা শরীরের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রস্তুতির পরিসর আরও বিস্তৃত। যার অন্যতম শ্রেণিকক্ষে বসার ব্যবস্থাপনার পুনর্বিন্যাস। ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করার মতো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা নেই বলইে চলে। যেখানে আমাদের শ্রেণিকক্ষ সংকটে অনেক বিদ্যালয়ে দুই শিফটে শ্রেণি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়, যেখানে গাদাগাদি করে বসেই শিক্ষার্থীদের শ্রেণি পাঠে মনোযোগী হতে হয়, সেখানে এত দূরত্ব বজায় রাখার উপায় কী? জার্মানি, ইংল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ আলাদা শিফট করে কিংবা একই সময়ে দুটি কক্ষে শ্রেণি কার্যক্রম সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়েছে; সেই সামর্থ্যই-বা আমাদের কতটা রয়েছে। প্রতিবেশী থাইল্যান্ডে গত সপ্তাহে স্কুল খুলেছে। সেখানে একটি স্কুলের বাচ্চাদের বসার আলাদা ডেস্কগুলো ব্যালটবক্সের মতো তিন দিকে বন্ধ রেখে সাজানো হয়েছে। আমাদের জন্য উদাহরণ হতে পারে জাপান। সেখানেও শিক্ষার্থীরা শিফট অনুযায়ী এক দিন বাদে এক দিন ক্লাস করছে। ফলে প্রতিদিন অর্ধেক টেবিল খালি থাকায় স্বাভাবিক দূরত্ব নিশ্চিত হচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরস্পরের সরাসরি যোগাযোগ ঘটে- এমন কার্যক্রম বন্ধ রাখা দরকার। যেমন স্কুল সমাবেশ (অ্যাসেম্বলি)। একইসঙ্গে মাঝে বিরতির (টিফিন) সময় কমিয়ে আনা, বিদ্যালয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় সবাই যাতে একত্র না হয় সে জন্য শ্রেণিভিত্তিক সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা কীভাবে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করবে সেটিও ভাবনার বিষয়। গ্রামে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই হেঁটে আসা-যাওয়া করতে পারে। কিন্তু শহরে যারা দূর থেকে বিদ্যালয়ে আসে, তাদের জন্য সমস্যা হতে পারে। কারণ গণপরিবহন ব্যবহারে ঝুঁকি থেকেই যচ্ছে। ব্যক্তিগত পরিবহন এক্ষেত্রে নিরাপদ। তবে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ সাইকেল ব্যবহার করা এবং হেঁটে আসা-যাওয়া করা। যদিও আমাদের রাজধানীর সড়কগুলোতে সাইকেল চালানোর রুট কিংবা ব্যবস্থা নেই। আর হাঁটার পরিবেশও তথৈবচ।
চার-পাঁচ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে পড়াশোনায় যে ব্যাঘাত ঘটেছে, সেটি পুষিয়ে নিতে সিলেবাস, পরীক্ষা, পরবর্তী শিক্ষাবর্ষও মাথায় রাখতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে সরকার যে চিন্তাভাবনা করছে তা শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাম্প্রতিক বক্তব্যে স্পষ্ট। তিনি বলেছেন- 'করোনার কারণে চলতি শিক্ষাবর্ষ আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়তে পারে। পাশাপাশি শ্রেণিঘণ্টার সঙ্গে সমন্বয় করে কমানো হতে পারে মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন শ্রেণির সিলেবাস। এমন পদক্ষেপের কারণে আগামী বছরে ঐচ্ছিক ছুটি কমিয়ে আনা হতে পারে। যেসব পরীক্ষা এখনও অনুষ্ঠিত হয়নি সেগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনা যায় কিনা তাও ভাবছি।' আমরা চাই সংশ্নিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়গুলোর বিস্তারিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া হোক।
করোনার প্রভাবে নিশ্চয়ই অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে জন্য শিক্ষার্থীর আর্থিক অবস্থাও বিবেচনা করা দরকার। বলা চলে বাংলাদেশের জন্য এটিই হবে সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি। বিদ্যালয়ে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা ও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়কেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। শিক্ষকদের সহায়তায় শিক্ষার্থীর পরিবারের অবস্থা জেনে, পরিবারগুলোকেও আপৎকালীন সহযোগিতা দেওয়া যেতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, কোনো শিক্ষার্থী যেন শিশুশ্রম কিংবা বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে বিদ্যালয় থেকে ঝরে না পড়ে।
উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করোনা পরীক্ষারও ব্যবস্থা করছে। অন্তত এমন হতে পারে- বিদ্যলয়গুলোর জন্য ভ্রাম্যমাণ করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। কেউ আক্রান্ত হলে তার কিংবা তার সংস্পর্শে আসা শিক্ষার্থীদেরও দ্রুত পরীক্ষা নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের কথাও ভাবতে হবে। শিক্ষকরা যেন যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রেণিকার্যক্রম সম্পন্ন করেন তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বলাবাহুল্য, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমলেই নিশ্চয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। তার পরও করোনার প্রতিষেধক আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত এ ভাইরাসের প্রকোপ থাকবে বলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই প্রস্তুতিগুলো সম্পন্ন করতে হবে। না হলে একজন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে গোটা বিদ্যালয় এবং এর মাধ্যমে অভিভাবক, শিক্ষক ও অন্যদের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা জারি করা দরকার। সময়ক্ষেপণ না করে যত দ্রুত সম্ভব তা করতে হবে।

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।