Mahfuzur Rahman Manik
শিশুর বিকাশ ও আমাদের ভবিষ্যৎ
নভেম্বর 20, 2018

এমন একসময় জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন শিশু দিবস উপস্থিত, যখন শিশুদের নিয়ে নানা মন খারাপের ঘটনা চারদিকে দেখছি আমরা। ইন্টারনেটে শিশু পরিস্থিতি খুঁজতে গেলে সামনে আসবে—শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, অপুষ্টি, শিশু নির্যাতন, শিশু অধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি। এর বাইরেও সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিয়ানমারসহ নানা দেশে বড়দের জিঘাংসার শিকার শিশুদের ভেবে আমরা শিউরে উঠি। আফ্রিকার কোনো কোনো দেশের হাড্ডিসার শিশুর চিত্র আমরা হতবাক হয়ে দেখি। বিশ্বব্যাপী এসব চিত্র হতাশ করে বটে, তার পরও আমরা আশার আলো দেখি, পৃথিবীব্যাপী নানামুখী উদ্যোগ আমাদের প্রেরণা জোগায়।

সর্বজনীন শিশু দিবসটি জাতিসংঘ ঘোষিত ১৯৫৯ সালের ‘শিশু অধিকার ঘোষণা’ ও ১৯৮৯ সালের ‘শিশু অধিকার কনভেনশন’ প্রণয়নের দিন তথা ২০ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে শিশু দিবস পালন করা হয়। আমাদের দেশে ১৯৯৬ সাল থেকে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটিকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আর অক্টোবরের প্রথম সোমবারকে ধরা হয় বিশ্ব শিশু দিবস। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জুনের ১ তারিখ শিশু দিবস। আর সর্বজনীন শিশু দিবস নভেম্বরের ২০ তারিখ।

তারিখ যেটাই হোক না কেন, সবারই কথা শিশুদের জন্য সুন্দর একটা আবাসন গড়ে তোলা। শিশুদের উপযোগী করে বিশ্বকে তৈরি করা। আর এসবই হচ্ছে বড়দের নৈতিক দায়িত্ব। অবশ্য শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরাপদ ‘নীল’ বিশ্ব গড়ার আহ্বান জানিয়ে এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘চিলড্রেন আর টেকিং ওভার অ্যান্ড টার্নি দ্য ওয়ার্ল্ড ব্লু।’ বলা বাহুল্য জাতিসংঘের এ ‘নীল’ দিয়ে রাঙানোর ঘটনা হয়তো প্রতীকী। কিংবা এক দিন রাঙালেই শিশুর সার্বিক নিরাপত্তা, বর্ধন, বিকাশ নিশ্চিত হবে না। তার পরও হয়তো এটা মাইলফলক হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের শিশুদের অবস্থা বিশ্ব শিশু পরিস্থিতির মতোই বলা চলে। তবে হ্যাঁ, আমরা মা ও শিশুর মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে কমিয়ে আনতে পেরেছি। শিশু অধিকার সুরক্ষায় আমরা এগিয়েছি। তার পরও নানা দিক থেকে আমাদের এখনো কাজ করা প্রয়োজন। শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, অপুষ্টি, শিশু নির্যাতন, শিশু অধিকার ইত্যাদিতে যেমন নজর দিতে হবে, তেমনি শিশুর সৃজনশীলতা, শিশুর বিকাশ, শিশু সাহিত্য ও শিশু শিক্ষায় আরো কাজ করা জরুরি। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে আনন্দময় পরিবেশে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উপযোগী শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। অথচ বাস্তবে স্কুলগুলোতে শিশুদের ওপর বই আর পড়ার চাপ ক্রমেই বাড়ছে। বই বাড়লেও বাস্তবে শিশুর সৃজনশীলতা, শিশুর মন ও মনন উপযোগী বই কিংবা বইয়ের উপস্থাপনা যথেষ্ট নয়। এটা ঠিক, আগে শিশুদের বয়সভিত্তিক বই তেমন ছিলই না। বিশেষ করে আর্লি গ্রেড বা একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ের বই কিংবা তাদের টার্গেট করে গল্প ও অন্যান্য লেখা কম ছিল। এখন সেটা শুরু হয়েছে। অনেকে তা নিয়ে কাজ করছে। শিশুদের কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে।

তবে আমাদের শিশুদের পড়ার যে চাপের মধ্যে থাকে বা থাকতে হয়—এ অবস্থায় তাদের বিকাশ কতটা যথাযথ হচ্ছে, তা ভাবার বিষয়। আমাদের দেশে বেশি পরীক্ষাও এ বিকাশে অন্যতম বাধা। বিশেষ করে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পর পাবলিক পরীক্ষা শিশুর চাপ আরো বাড়িয়েছে। পরীক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী বছর থেকে সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থীদের রিপোর্ট কার্ডে থাকবে না—কোনো গ্রেড, সর্বনিম্ন-সর্বোচ্চ নম্বর, রং দিয়ে দাগানো ফেল নম্বর, মোট নম্বর ও খারাপ গ্রেড। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের তুলনার বদলে পড়ার প্রতি বেশি উৎসাহিত করতে এ উদ্যোগ নিয়েছে।

এখন শিশুর যে বিকাশের কথা সবাই বলছে তার জন্য জরুরি বিষয়গুলো হলো—তার খেলাধুলা, শিশু উপযোগী সাহিত্য, সামাজিক নানা অনুষ্ঠান ও মিথস্ক্রিয়া। শিশু তার চারপাশ থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে। চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা সে খুব যত্নের, গুরুত্বের সঙ্গে, তীক্ষভাবে অবলোকন করে। এ জন্য শিশুর চারপাশটাকে সুন্দর ও সাবলীলভাবে তৈরি করা বড়দের দায়িত্ব। পরিবারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে শিশুকে ইতিবাচকভাবে চিন্তা করার উপযোগী করে তোলা। মানুষের প্রতি তার মমতা তৈরি করে দেওয়ার কাজটা অবশ্যই পরিবারকে তৈরি করে দিতে হবে।

শিশুকে শারীরিক আঘাত করা নিষেধ। মানসিকভাবেও যেন শিশুরা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, সেটাও পরিবার ও বিদ্যালয়ের জানা ও মানা দরকার। তার সহপাঠী, বন্ধুদের সঙ্গে সে ঠিকভাবে মিশতে পারছে কি না, তারা তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে, কোনো আত্মীয় দ্বারা সে শারীরিক বা মানসিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছে কি না—এগুলোও পরিবারকে নিশ্চিত হতে হবে। আমরা মনে করি, শিশুর সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক হতে হবে মধুর। বন্ধু হিসেবে সে যেন গণ্য করে। যেন সংকোচহীনভাবে সব কথা মা-বাবার সঙ্গে বলতে পারে এদিকটা দেখার দায়িত্ব মা-বাবাকেই নিতে হবে। তৈরি করতে হবে এ রকম পরিবেশ। মা-বাবা যেন হয় তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।

শিশুকে আত্মমর্যাদা শেখাতে হবে। নিজের মূল্য বুঝতে শেখাতে হবে। স্বার্থপরতা থেকে দূরে রাখতে হবে। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা শেখাতে হবে। এদিকগুলো অবশ্যই পরিবারের, বিশেষ করে মা-বাবাকে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে শিশু বড় হবে আত্মশক্তি আর দায়িত্বের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে।

শেষেও আমরা বিকাশের কথাই বলছি। শিশুর বিকাশে পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ, রাষ্ট্র—সবাই এগিয়ে আসুক। শিশু উপযোগী সুন্দর একটি সমাজ আমরা চাই। শিশুদের সৃজনশীলভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করি।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।