Mahfuzur Rahman Manik
রোহিঙ্গাদের জন্য আশার বাণী নেই !
একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবন তো রোহিঙ্গা শিশুদেরও প্রাপ্য

বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী বসতি কক্সবাজার। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এ জেলায় গত বছর প্রথম সফরে আসি। তখন একটি বাঁশের সাঁকো দিয়ে পার হই, যেটি শরণার্থীরা তৈরি করেছে। এ সাঁকো কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের পূর্ববর্তী শরণার্থী শিবিরের সঙ্গে নতুন ক্যাম্পের সংযোগ স্থাপন করেছে। সাঁকোটি এখানে শরণার্থীদের যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পথ দিয়ে শরণার্থীদের ঘর তৈরির সামগ্রী, কম্বল, সোলার বাতি ইত্যাদি বিতরণ কেন্দ্র থেকে পুরনো শিবির হতে নতুন শিবিরে আনা-নেওয়া হচ্ছে। সাঁকোর নিচের পানিপ্রবাহ বৃষ্টি হলে যেন নদীতে পরিণত হয়। শরণার্থীরা প্রথম সে স্থানটি সাঁতরে পার হতো। পরে পানির ওপরে বাঁশ দিয়ে এ ব্যবস্থা তৈরি। এখন সেখানে তিনটি সাঁকো।

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থী স্রোত আসা শুরু হয় গত বছরের আগস্ট থেকে। তাতে সাত লাখ ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা আসে।

২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবসটি রোহিঙ্গাদের মতো শরণার্থীদের দুর্দশার কথা কেবল স্মরণ করেই উদযাপন নয়, বরং আমাদের উচিত, তাদের সংকটের সমাধানেও এগিয়ে আসা। আমরা যদি রোহিঙ্গাদের অন্য জীবন দেখি, সেখানে আমি অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, তাদের কারও কারও এমনকি প্রকৌশলীর গুণও রয়েছে। তাদের যদি প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হয়, তারা যে কোনো কিছু তৈরি করে দিতে সক্ষম। সর্বাগ্রে সাঁকো নির্মাণে তাদের সহযোগিতা করা উচিত।

বাংলাদেশে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) বৃষ্টির সময়ে শরণার্থীদের বাঁচাতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। এ সময়ে রয়েছে বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি। আমরা ১৫শ' শরণার্থীকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকায় স্থানান্তরে সাহায্য করেছি। তবে আরও শরণার্থী যারা তাদের আশ্রয়স্থল রক্ষায় দিনরাত চেষ্টা করছে, তাদেরও সহযোগিতার চেষ্টা করা দরকার।

কেবল পানির ওপর সাঁকো তৈরিই নয় বরং শরণার্থী ও যারা তাদের উদার চিত্তে গ্রহণ করেছে, সে মানুষের সঙ্গেও তাদের সেতুবন্ধ স্থাপন করা দরকার। দশ মাসে একটা জায়গায় প্রতিবেশী দেশের সাত লাখের অধিক মানুষের আগমন ও তাদের আশ্রয় দেওয়া সাধারণ কোনো বিষয় নয়। ফলে বিশ্বসমাজের উচিত, সবার জন্যই বিনিয়োগ করা, বিশেষ করে যারা এত শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, সে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়ন করা।

তবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিজস্ব আবাসভূমির মানুষের সঙ্গে পুনরায় সেতুবন্ধ স্থাপন সবচেয়ে কঠিন। যদিও বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় সরকার সম্মত হয়েছে যে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে ঐচ্ছিক, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ। রাখাইন, যেখান থেকে শরণার্থীরা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, সে রাজ্যটিকে একটি একীভূত ও ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির রাজ্যে পরিণত করতে, সাবেক জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নেও মিয়ানমার সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। এ মাসের গোড়ার দিকে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) রোহিঙ্গাদের তাদের নিজস্ব আবাসভূমিতে ঐচ্ছিক, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনকে সহজ করতে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে।

একে বলা যায় কেবল শুরু। যদিও মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি ঐচ্ছিক, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের অনুকূল নয়। এমনকি যেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে রয়ে গেছে, তারা এখনও বৈষম্য ঘুচিয়ে নাগরিকত্ব লাভের চেষ্টা করছে। তাদের অধিকাংশ এখনও স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে পারেনি। রাখাইনের শহর এলাকার প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ যারা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত, যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা তারা শিগগিরই ক্যাম্পে বসবাসের সাত বছরে প্রবেশ করছে।

এসব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শরণার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই মিয়ানমার ফেরত যেতে ভয়ে আছে। তাদেরও মিয়ানমারের স্থানীয়দের মধ্যকার সেতুবন্ধ যেন অনেক দূরের বিষয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি, এই শূন্যস্থান যতটা সম্ভব কমানোর।

মিয়ানমারের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপির রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিতে রোহিঙ্গারা ফিরে এলে যাতে যথাযথ জায়গা ও সম্মান পায়, সে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। একই সঙ্গে উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশের আলোকে রাখাইনে সবার জন্য নাগরিকত্ব, চলাফেরার স্বাধীনতা, স্বাস্থ্যসেবা ও বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা পরিকল্পনা করছি।

অনেক শরণার্থী আমাদের বলেছেন, তারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয়ে রয়েছে। গত মাসেও যখন আমি কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে একটি পাহাড়ের চূড়া থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির দেখছিলাম, তখন সংকটের প্রথম দিকে গত বছর ওই বাঁশের সাঁকো পার হওয়ার সময় এক তরুণ মানবিক কর্মীর কথা স্মরণ করছিলাম, যিনি রাখাইনে এক বেসরকারি সংস্থার হয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশে নিরাপদবোধ করছেন এবং মিয়ানমার যেতে ভয় করছেন। তার অগ্রসর হওয়ার কোনো পথ ছিল না, না ছিল ফিরে যাওয়ার আশা।

রোহিঙ্গা তরুণদের জন্য এটি এক বেদনাদায়ক ও ভয়াবহ পরিস্থিতি। আবার সেখানে অর্ধেকের বেশি রয়েছে শিশু। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হাজারো শিশু রয়েছে, যাদের সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে- তারা রয়েছে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আমরা কি তাদের জন্য কোনো আশার বাণী শোনাতে পারব? অন্তত তাদের পক্ষে, তাদের কথা চিন্তা করে আমাদের অবশ্যই এই সংকটের সমাধান করতে হবে। এটা কেবল আজকের শরণার্থী দিবসের প্রতিজ্ঞাই নয় বরং প্রতিদিন শয়নে-স্বপনে আমাদের এ চিন্তা থাকতে হবে, যতক্ষণ না আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়। যতক্ষণ শত বিপদ কাটিয়ে তাদের নিরাপদ জীবনের সেতুবন্ধ তৈরি না হচ্ছে। একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবন তো তাদেরও প্রাপ্য।

 

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।