Mahfuzur Rahman Manik
দুটি স্ট্যাটাস মিস, তৃতীয়টির গল্প
মার্চ 26, 2018

স্ট্যাটাস দিয়েই গল্পটা শুরু করা যাক, ফেসবুকে আমার ওয়ালে যেটি পোস্ট করা হয়ে গেছে- ‘আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে ছোট ভাইয়ের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য অভিনন্দন Mahbubur Rahman Masum।’ চান্স বলতে ভর্তির সুযোগ। কিন্তু যদি বলি ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা কিংবা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হিসেবে নাম আসা- সে স্বপ্ন অবশ্য মাসুমের অনেক আগেই পূরণ হয়েছে। অনেক আগে মানে গত বছর। সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। ঘ ইউনিটে। বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ড, এখানে সিরিয়াল দূরে বলে ভর্তি হতে পারনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওর নিজস্ব বিজনেস এর সি ইউনিটেও উত্তীর্ণ হয়। এখানেও সিরিয়াল আসেনি। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একবারই ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ। তাই এবার অন্যগুলোতে মনোযোগ। এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বিজনেস, আইবিএ ও সামাজিক বিজ্ঞান তিন ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে সবগুলোতেই পাশ করে। কিন্তু সেই সিরিয়ালের ভূত যে তাকে ছাড়ে না। তার কোটা নেই, দুইটায় এ প্লাস নেই। সুতরাং ভর্তির সুযোগ আর হয় না। এক্ষেত্রে এসএসসি এইচএসসির ফল যে তাকে ভুগিয়েছে, বলাই বাহুল্য। এ দুই পরীক্ষায় তার ফল চার (৪.০০) এর নিচে নয় আবার সাড়ে চার (৪.৫০) এর উপরে নয়। মূল ভর্তি পরীক্ষায় মোটামুটি মার্কস পেয়েও অনেকে দুইটায়ই জিপিএ-৫ বা খুব ভালো ফল দিয়ে এগিয়ে যায়। মাসুমের ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। এভাবে প্রথম বছর গেলো, দ্বিতীয় বছরও যায় যায়। আমাদের চাঁদপুরের প্রতিবেশি হিসেবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিশেষ নজর থাকলেও এ বছর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের দীর্ঘসূত্রীতায় আশা করা না করা সমান হয়ে দাঁড়ায়।
সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। অথচ কুমিল্লার ভিসি নিয়োগেরই খবর নেই। নভেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঝুলে থাকে- অনিবার্য কারণে ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত। তারিখ পরে জানানো হবে। ইতিমধ্যে মাসুম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তারপরও দৃষ্টি কুমিল্লায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যে একটু আশা তাও ঝুলে আছে। নভেম্বর গেলো, ডিসেম্বর গেলো, জানুয়ারি যয়। কিন্তু কুমিল্লার ‘কু’ যে সরে না। টেনশন টেনশন। ভিসি নাই। পরীক্ষা আদৌ হবে কি-না ঠিক নেই। ও জাতীয়তে যায়, যায় না। এভাবেই আসে ফেব্রুয়ারি। সেখানে পরিচিত শ্রদ্ধেয় এক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলি, খোজ নেই। তিনি এ নিয়ে পত্রিকায় লিখেনও। অভিভাবক ছাড়া একটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামনে চলে। যাহোক, একটা সময় বলেন ভিসি শীঘ্রই নিয়োগ হবে। অবশেষ কুমিল্লার সন্তান আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী কুমিল্লা বশ্বিবিদ্যালয়ে ভিসি হন। ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে।
ছোট ভাই সেখানে চান্স পায় বি ইউনিটে মানে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে। এর মাধ্যমে আসলে কেবল তার স্বপ্নই নয়, আমাদের পরিবারের সকলের স্বপ্নও পূরণ হয়। মাসুম পরিবারের সকলের ছোট। সবার দৃষ্টি তার দিকে। সাধারণত বড় ভাই মোটামুটি ফল করলে, ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়লে সবাই আশা করে ছোট ভাই তারচেয়েও ভালো করবে। সেদিক থেকে তার ওপর অনেক চাপ ছিলো। তার এসএসসির ফলে তাই সবার বড় আশা আশাই থেকে যায়। এরপর ও ঢাকা আসে। এইচএসসিতে ভর্তি হয় ঢাকা কমার্স কলেজে। সেখানে ফল কিছুটা উন্নত হলেও আশাপ্রদ হয়নি। সবাই ভেবেছে অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে প্রত্যাশা পূরণ করবে। কিন্তু এখানেও হোচট। ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করে অথচ ভর্তি হতে পারে না। এত ভর্তি পরীক্ষায় আমি নিজেও পাশ করিনি (আসলে এতগুলো পরীক্ষাই আমি দেইনি)। ওয়েটিং-এ থাকা সে এক বেদনা।
তারপরও অামি সবাইকে বুঝাই, সে পাশ করে মানে তার বেসিক ভালো আছে। কোথাও না কোথাও হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। সেটা হলোও বটে। শেষে হলেও বাড়ীর কাছে। স্বপ্ন পূরণ হলো অবশেষে। কিন্তু স্ট্যাটাস? আমাদের সময় ফেসবুক ছিলো না। মাসুমদের কালে এসেছে। ও এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-ফাইভ পেলেও হয়তো আমি স্ট্যাটাস দিতাম। আমার ছোট ভাইয়ের ভালো ফল সবার মাঝে শেয়ার করতাম।
ফল গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভালো মানুষ হওয়া। কোথায় পড়লা তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কতটা ভালো মানুষ হইলা। প্রিয় ভাই এটা জীবনের মাত্র শুরু। পড়াশোনা, জ্ঞানচর্চা, নিজকে গড়ার সময় এটাই। জীবনে, কী হবে, কতদূর যাবে, কেমন কাটবে বাকীটা সময়- এখানকার প্রস্তুতিই বলে দেবে। মনে করো না বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অফুরন্ত সময়। না। গড়ার সময়, শেখার সময় এটাই। তারুণ্যের, উদ্যমের, কাজের এ সময়টা হেলায় কাটানোর নয়, সারারাত ফেসবুক, চ্যাটিং, মোবাইলে কথা বলার নয়। মনে রেখ পরিবার, সমাজ, দেশ, স্রষ্টার সবার প্রতি তোমার দায়িত্ব আছে। সে চাপ নিয়ে নয়, বরং স্বাচ্ছন্দ্যে থেকে ব্যস্ততার নিরিখে জীবন কাটাও। মনে রেখ দিন শেষে তোমার জীবন তোমারই। এটা নিজের জীবন, সেটা বোঝার সময় এখনই। এটা তোমার জীবন, টার্গেট নেওয়ার সময় এখনই। তোমার ভবিষ্যত, তোমার হাতেই। তুমি কিছু হলে অন্যকে গর্বের সঙ্গে বলতে পারবো, তোমার পরিচয় আমাদেরও হয়তো মহিমান্বিত করবে।
আমার কাছে ভালো লাগছে যে, তৃতীয় স্ট্যাটাস আমি দিতে পারছি, এটিই প্রথম দুটির বেদনা উপশম করছে। কষ্ট লাগছে অনেক দিনের একসঙ্গে থাকা হচ্ছে না। দুটি বাক্য দিয়ে শেষ করি (কার যেন, জানা নাই)- প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিলো সবে। এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন।

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।