Mahfuzur Rahman Manik
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সবার সহায়তা চাই
ডিসেম্বর 6, 2017

মূল: শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের আমন্ত্রণে কম্বোডিয়ায় সফরে আমি ভীষণ আনন্দিত। তিন দিনের সফরে আমার ও দেশবাসীর তরফ থেকে কম্বোডিয়ার জনগণের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা। বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার মধ্যে বন্ধুত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ ও অভিন্ন মূল্যবোধের কারণে উভয় দেশের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।

আমি প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের ২০১৪ সালের ১৬-১৮ জুন বাংলাদেশ সফরের কথা স্মরণ করছি। ভৌগোলিক নৈকট্য সত্ত্বেও আমাদের দু'দেশের মানুষের মধ্যে এক বড় ফারাক রয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সফর সে ফারাক ঘোচাতে সাহায্য করে, যেখানে দু'দেশের জনগণ বিশেষত ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া উভয় দেশের মানুষকেই তাদের স্বাধিকারের জন্য প্রায় একই ধরনের নৃশংসতা সহ্য করতে হয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতিধারায় একটি স্থিতিশীল দেশ; কম্বোডিয়ার অবস্থাও তদ্রূপ। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ শক্তিশালী অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। আজ কম্বোডিয়াকেও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে দেখে আমি আনন্দিত।

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না; পদে পদে আমাদের অনেক বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করতে হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন; দুই লাখ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছেন। তখন পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার আন্দোলন করেনি; এর মধ্যে এমনকি কিছু মানুষ স্বাধীনতার বিরোধিতাও করেছিল।

স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় যখন যুদ্ধোত্তর দেশটি ব্যাপক পুনর্গঠন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমার বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের ১৮ সদস্যসহ হত্যা করা হয়। আমি ও আমার ছোট বোন রেহানা বিদেশে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যাই।

বাবা নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যারা চায়নি, তখন সে বিরোধী শক্তিও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশ হয়ে যায়। বাংলাদেশের জনগণ দুই যুগের বেশি সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পড়ে। তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়।

ছয় বছর নির্বাসনের পর ১৯৮১ সালে আমি দেশে ফিরে মানুষের মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করি। ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠন করি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবার ২০০৮ সালে বিজয়ী হয়; এখনও আমরা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ, যেখানে মানুষের জীবিকা চাষাবাদের জমি ও প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক সূচকের ঊর্ধ্বগতি কেবল গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ এবং জনগণের সাহস ও প্রষ্টোর ফলেই সম্ভব হয়েছে।

এক দশক আগে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান কেমন ছিল? ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ, এখন সেটা ২২ শতাংশ। তখন মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ ডলার আর এখন ১৬১০ ডলার। এটা প্রত্যাশিত যে, ২০২১ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ১৬-১৭ শতাংশের নিচে নেমে যাবে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার এবং গড় আয়ুর দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে।

গত বছর আমাদের জিডিপির ৭.২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আর ৬ শতাংশের কম মুদ্রাস্ম্ফীতিই আমাদের অর্থনীতির বলিষ্ঠতার প্রমাণ করছে। ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তিন বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে লিঙ্গ সমতায় সবার শীর্ষে, ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম।

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাঘাটও এখন পাকা, সড়কের মাধ্যমে এক গ্রামের সঙ্গে অন্য গ্রামের সংযোগ ঘটছে। খড়ের ঘরবাড়ি টিনে রূপান্তরিত হয়েছে। অধিকাংশ গ্রামেই বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। ফলে রাতে হারিকেন-কুপির বদলে বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহূত হচ্ছে। এখনও যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছেনি, সেখানে প্রায় ৪৫ লাখ ঘরে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহূত হচ্ছে।

শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আমাদের সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। অসচ্ছল পরিবারের মেয়েদের জন্য বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে, মেয়েদের শিক্ষা এমনিতেই অবৈতনিক। মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বছরের প্রথম দিনই বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়। দেশে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামও ডিজিটাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত।

আমার সরকার বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল ও দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে গেছে। আমি সবসময়ই বলি, দরিদ্রতা মানবজাতির প্রধান শত্রু। আমরা ক্ষুধা প্রায় জয় করেছি। ১৮ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক ও গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। বর্তমান ধারা ও উন্নতি অব্যাহত থাকলে আমার দেশের মানুষের টেকসই ও উন্নত জীবনের স্বাদ পেতে বেশিদিন লাগবে না।

মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মানবিক সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন একটি অপ্রত্যাশিত সংকটের মোকাবেলা করছে। আমরা মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দিয়েছি; কিন্তু তাদের খাদ্য প্রদান ও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আশ্রয় দেওয়া কঠিন। মিয়ানমারকে অবশ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে তার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে হবে। এ সংকটের সমাধানে আমরা বিশ্বের সবার সহায়তা চাই।

অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের পর জঙ্গিবাদের উর্বর ভূমি হতে যাচ্ছে। আসলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম প্রপঞ্চ; এই হুমকি থেকে কোনো দেশই নিরাপদ নয়। তবে আমাদের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামর্থ্য বাড়ানো হয়েছে। অধিকন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই ধর্মের নামে সহিংসতা সমর্থন করে না। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা প্রচারণা শুরু করেছি।

বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার মধ্যে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অনেক মিল রয়েছে। আমরা উভয় দেশই মানুষের জীবন মান উন্নয়নে কাজ করছি। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ-কম্বোডিয়া চারটি চুক্তিতে সই করে। কৃষি, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উভয় দেশের মানুষের উপকারের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পন্ন হয়। আর বর্তমান এ সফরে আরও দশটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই হবে।

বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় পর্যায়ে একটি শক্তিশালী ও উভয়ের জন্য উপকারী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বৃহত্তর আঞ্চলিক সহযোগিতায় আর্থ-সমাজিক উন্নয়ন, শান্তি ও অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একত্রিত হয়ে কাজ করছে। আমি আশা করি, আমার এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।