Mahfuzur Rahman Manik
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অবকাঠামোগত উন্নতি দেখে ভালো লাগছে

সাক্ষাৎকার// ড. হেলেন জারভিস

ড. হেলেন জারভিস মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে ঢাকায় তিন দিনের 'পঞ্চম বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস' সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশে আসেন। নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি কম্বোডিয়ার গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে কাজ করছেন। কম্বোডিয়ার গণহত্যার বিচারে গঠিত এক্সট্রা অর্ডিনারি চেম্বারস ইন দ্য কোর্ট অব কম্বোডিয়ার (ইসিসিসি) তথ্য বিভাগের সাবেক এ প্রধান কর্মকর্তা পিএইচডি করেছেন ইউনিভার্সিটি অব সিডনি থেকে। কম্বোডিয়া সরকারের উপদেষ্টা ড. হেলেন অস্ট্রেলিয়া ও কম্বোডিয়া উভয় দেশের নাগরিক। বাস করেন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে- সাক্ষাৎকার গ্রহণ :মাহফুজুর রহমান মানিক

সমকাল :আগেও আপনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসেছেন, এবার এসে নতুন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কেমন দেখছেন?

ড. হেলেন জারভিস :মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন আগে দেখিনি। শুনেছি সম্প্রতি নতুন ভবন উদ্বোধন হয়েছে। অবশ্যই এটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অবকাঠামোগত উন্নতি, দেখে ভালো লাগছে। এটি সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। এখানকার কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা কেবল ভবনকেই চিত্তাকর্ষক করছেন না, একই সঙ্গে কমিউনিটির সঙ্গেও কাজ বাড়াচ্ছেন। এটা নিঃসন্দেহে ভালো। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এই পরিবেশ গবেষণা ও ডকুমেন্টেশনের কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই সহায়ক হবে।

সমকাল :বাংলাদেশে 'জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস' শীর্ষক কনফারেন্সও আপনার কাছে নতুন নয় ...

ড. হেলেন : হ্যাঁ, এর আগেও আমি এই কনফারেন্সে এসেছি। লেকচার দিয়েছি। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উইন্টার স্কুলেও এসেছি।

সমকাল :আপনি অনেক বছর ধরে কম্বোডিয়ায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. হেলেন : বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। বাংলাদেশে যে মাত্রায় মানবতাবিরোধী কাজ হয়েছে তার প্রভাব থাকবে দীর্ঘদিন। নারীরা নির্যাতিত হয়েছেন। অনেক হিডেন জেনোসাইডও হয়েছে। মানুষ আপনজন হারিয়েছে। এসব দুঃখগাথা বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জেনেছি।

সমকাল :আপনি কি কম্বোডিয়ার গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী? বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার গণহত্যাকে আপনি কীভাবে মেলাবেন?

ড. হেলেন :না, আমি দেখিনি। আমি ১৯৬৭ সালে কম্বোডিয়া ত্যাগ করি। ২০ বছর পর ১৯৮৭ সালে আবার কম্বোডিয়ায় ফিরি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ক্ষমতায় ছিল খেমাররুজরা। এই চার বছরে খেমাররুজ সরকার নির্মম গণহত্যা চালায়। কম্বোডিয়ার কোনো কোনো ঘটনা এমনকি নৃশংসতার দিক দিয়ে বাংলাদেশ থেকেও ভয়াবহ। দুই দেশের গণহত্যা আসলে দু'রকম, দু'দেশের কনটেক্সটে তা সংঘটিত হয়েছে। তবে ধরনের দিক থেকে একই রকম। উভয় গণহত্যায়ই মানুষ মারা গেছে। আপনজনের হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের বেদনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। বিশেষ করে কম্বোডিয়ায় এত অধিকসংখ্যক মানুষ মেরে ফেলা তো অকল্পনীয়। কম্বোডিয়ায় খেমাররুজের প্রয়াত নেতা পলপট শুরু করেন এক ত্রাসের রাজত্ব। সে সময় মাত্র চার বছরের শাসনে দশ থেকে বিশ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। খেমাররুজের সমর্থকদের হাতে শিক্ষক, পেশাজীবীরাও রেহাই পাননি।

সমকাল :মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা নিয়ে কাজে সম্পৃক্ত হলেন কীভাবে?

ড. হেলেন : প্রথমত অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে। এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান থেকে। দ্বিতীয়ত কাজের সূত্রে, লাইব্রেরিয়ান ও ডকুমেন্টালিস্ট হিসেবে। আমি কম্বোডিয়ার পুরো গণহত্যার ঘটনার ডকুমেন্টেশনের কাজ করি। আমি ইয়েল ইউনিভার্সিটির কম্বোডিয়ান জেনোসাইড প্রোগ্রামে কাজ করি। কম্বোডিয়ায় সংঘটিত গণহত্যার বিচারে সরকারের সঙ্গেও একনিষ্ঠভাবে কাজ করি। কাজের সূত্র ধরেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রও এটি।

সমকাল : বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচার নিয়ে আপনার অভিমত কী?

ড. হেলেন :এটা খুবই সাহসী ও প্রেরণাদায়ক উদ্যোগ। বাংলাদেশ সরকার ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচার শুরু করেছে। তবে অনেক বছর পর এ বিচারের কাজটি হচ্ছে। ইতিমধ্যে হয়তো অনেক তথ্য-প্রমাণ মুছে গেছে। তারপরও প্রসিকিউটররা কষ্ট করে প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন এবং বিচারকাজ সম্পন্ন হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিচারহীনরা বিচার পাবে। ডমেস্টিক ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হচ্ছে। বাংলাদেশে একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের ভয়াবহতা অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়ায় যে সাজা হয়েছে তা আইনে নির্ধারিত সর্বোচ্চ সাজা। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি আমৃত্যু কারাবাসের সাজাও হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায় থেকে সাজার আদেশ এবং রিভিউ আবেদন পর্যন্ত প্রক্রিয়া পর্যালোচনায় এ বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ বলেই প্রতীয়মান হয়।

সমকাল :বাংলাদেশের বিচার থেকে অন্যরা কি অভিজ্ঞতা নিতে পারে?

ড. হেলেন :এখানে প্রশ্নটা ন্যায়বিচারের। কোনো অপরাধের বিচারই যেন বন্ধ না থাকে। বিচার প্রক্রিয়া বিলম্ব মানে এমন নয় যে, বিচারকাজ শুরু করা যাবে না। এ অজুহাত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা যেন হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।

সমকাল : কম্বোডিয়ার গণহত্যার বিচার আর বাংলাদেশের বিচার- দুটিকে কীভাবে দেখছেন?

ড. হেলেন :কম্বোডিয়ার জনগণকেও দীর্ঘদিন বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। খেমাররুজ সরকারের পতনের পর গত ৩০ বছর ধরে এই গণহত্যার বিচারের দাবি উঠেছে দেশের মধ্য থেকে এবং দেশের বাইরে থেকে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে এই বিচার আয়োজনের প্রশ্নে অনুকূল পরিবেশ ছিল না। নব্বইয়ের দশকে এসে জাতিসংঘের সঙ্গে মিলে কম্বোডিয়ার সরকার এই আদালত গঠনের কাজে হাত দেয়। বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন পর বিচার কাজ শুরু হয়েছে ও চলছে।

সমকাল :এ ধরনের সম্মেলন কীভাবে বিচার কাজে সহায়ক হতে পারে?

ড. হেলেন :আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তারা এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণাপত্র, বক্তৃতা, আলোচনা শুনছেন। এর মাধ্যমে আরও সুন্দরভাবে কীভাবে বিচার কাজ সম্পন্ন করা যায় তার শিক্ষা অবশ্য নেবেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছেন। তারা নিজেদের দেশের অভিজ্ঞত এখানে শেয়ার করেছেন, তাদের কাছ থেকেও নেওয়ার বিষয় রয়েছে। বিশেষ করে আমি বীরাঙ্গনাদের কথা বলব। তাদের ত্যাগ কখনোই ভোলার নয়। বীরাঙ্গনারা যেন যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা পায় সে ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্মেলন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

সমকাল :বিচারের সঙ্গে জরুরি কাজ কী বলে আপনি মনে করেন?

ড. হেলেন : বিচারের সঙ্গে প্রধান কাজ হলো ডকুমেন্টেশন করা। প্রতিটি বিচারের রেকর্ড রাখা, আর্কাইভ করা। ভবিষ্যতের জন্য সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা। একই সঙ্গে তা যেন মানুষ সহজেই পেতে পারে সে ব্যবস্থা রাখা দরকার। এখন অডিও-ভিডিও আকারে সব রাখাও সহজ। সবগুলো যেন ইতিহাসের বিষয় হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত থাকে তা জরুরি।

সমকাল :সম্মেলনের ব্যস্ত সূচিতে চা-বিরতিতে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. হেলেন :সমকালকেও ধন্যবাদ। পাঠকদের শুভেচ্ছা।

সমকালে প্রকাশিত, ২৬ মে ২০১৭
ই-সমকাল থেকে দেখুন

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।