Mahfuzur Rahman Manik
তিস্তা চুক্তিকে পানিতে ফেলা নয়
ডিসেম্বর 18, 2016
তিস্তা নদীর উজানে পানির জন্য হাহাকার
তিস্তা নদীর উজানে পানির জন্য হাহাকার
মূল: জয়ীতা ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের অনিশ্চয়তা নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ-ভারত তিস্তা চুক্তি নিয়ে একমত হতে না পারাই এর প্রধান কারণ। এর আগে ২০১১ সালেও ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশ পানি বণ্টন চুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু সে সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতে তা হয়নি। চুক্তির খসড়ায় ছিল খরা মৌসুমে উভয় দেশ অর্ধেক অর্ধেক পানি পাবে। এটি তার রাজ্যের বিরুদ্ধে গেছে বলে মমতার আপত্তি। তিস্তার উৎপত্তি সিকিমে এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে রাজ্য সরকারের অনুমতি প্রয়োজন। এমনকি সংবিধানও বিষয়টির অধিকার রাজ্যকে দিয়েছে। কেন্দ্র-রাজ্য আলোচনায়ও জট না খোলায় তিস্তা চুক্তির বিষয়টি ঝুলে থাকে।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে নতুন গতি এলেও অনিষ্পন্ন তিস্তা চুক্তি ক্ষত হিসেবে থেকে যাচ্ছে। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। ভারত সব পণ্যে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশটির অবকাঠামো উন্নয়নে তিনশ' কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত।
শেখ হাসিনার সফরে দুই দেশের তরফ থেকেই অনেক চুক্তি অনুমোদন হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং সামরিক সহযোগিতা। তিস্তার সমাধান না হওয়ায় এসব ইতিবাচক বিষয় এগোতে পারছে না। কারণ জনগণের মধ্যে ভারত প্রসঙ্গে আলোচনায় বিষয়টি সবসময় সামনে আসে এবং তিস্তা বাংলাদেশের জন্য মর্মদাহের ব্যাপার।
পানি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নদীকে কেন্দ্র করেই এখানকার মানুষের বাস। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের কৃষিব্যবস্থা নদীর সঙ্গে জড়িত বলে দুই দেশেরই খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে তিস্তার পানি অন্যতম প্রধান উৎস। কৃষিকাজের জন্যই দুই দেশ আলাদাভাবে ব্যারাজ নির্মাণ করেছে। ভারতেরটা গজলডোবায় আর বাংলাদেশ সেচ প্রকল্প করেছে ডালিয়ায়।
বাংলাদেশ অভিযোগ করে আসছে, খরা মৌসুমে তারা পর্যাপ্ত পানি পায় না। কারণ উজানের গজলডোবা একতরফাভাবে সব পানি নিয়ে যায়, বাংলাদেশ খুব সামান্যই পায়। অধিকন্তু নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ বিবেচনায় বাংলাদেশকে একটি টেকসই চুক্তিই করতে হবে। কারণ ব্যারাজগুলো নির্মিত হচ্ছে উজানের দিকে সিকিমে। ফলে বাংলাদেশের ভয়, নতুন বাঁধ তিস্তার প্রবাহে আরও পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তিস্তা আরও স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। এর রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। প্রথমত, বাংলাদেশ ভাবে ভারত 'বড় ভাই'সুলভ আচরণ করে। দ্বিতীয়ত, ফারাক্কা ব্যারাজ নিয়ে বাংলাদেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে ভীত করে যেখানে ভাটির দেশ হিসেবে পানি পাচ্ছে না বলে বাংলাদেশের অভিযোগ, আর ভারত বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে। শেষত, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পারস্পরিক বাজিমাতে বারংবার ব্যবহৃত হয়। বিরোধী দল অভিযোগ করে যে, শেখ হাসিনা ভারতপন্থি এবং তিনি প্রায়শ বাংলাদেশের স্বার্থও উপেক্ষা করেন। তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়াকে তারা হাসিনার ব্যর্থতা হিসেবে চিত্রিত করে। প্রত্যেকটি দ্বিপক্ষীয় সফরকে বাংলাদেশে চুলচেরা লাভ-ক্ষতির পাল্লায় মাপা হয় আর এখন তিস্তা চুক্তি হচ্ছে সবচেয়ে বড় পরিমাপক। এ ছাড়া হাসিনা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণে সমালোচিত হচ্ছেন। ২০১৯ সালে যে নির্বাচন হওয়ার কথা তাতে আরও সমালোচনা সামাল দিতে তিস্তা চুক্তি শেখ হাসিনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রত্যাশার বিষয়, উভয় দেশই একে অন্যের সীমাবদ্ধতা শনাক্ত করছে এবং উভয়েই উইন-উইন সমাধানের (উভয়ের বিজয়) জন্য কাজ করছে।

 

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।