Mahfuzur Rahman Manik
স্বর্ণদ্বীপের ছবি
সেপ্টেম্বর 5, 2015
bookশিশু-কিশোর উপযোগী গল্প লেখা কঠিন কাজ। 'স্বর্ণদ্বীপের ছেলে'তে তা সহজ করে দেখিয়েছেন লেখক মাসুদ আনোয়ার। শিশু বা কিশোরদের জন্য লিখতে গেলে গল্প ও ভাষা উভয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হয়। কঠিন কোনো বিষয় এলে তাকে সহজ করে উপস্থাপন করতে হয়। মনোযোগ ধরে রাখতে কিংবা আকর্ষণ বাড়াতে শিশুতোষ নানা উপ-গল্পের আশ্রয় নিতে হয়। 'স্বর্ণদ্বীপের ছেলে' তারই প্রমাণ।
'উপনিবেশ টুপনিবেশের গপ্পো', 'যুদ্ধের কাল', 'ওয়াক থু', কিংবা 'মেঘের দুপুর'_ প্রত্যেকটি গল্পই আলাদা। লেখক কেবল গল্প লিখেই ক্ষান্ত হননি; নির্দিষ্ট বার্তা দিয়েছেন, কিশোর মনের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, অজানা বিষয় জানিয়েছেন। গল্পগুলোর কোনোটিতে গল্পের ছলে ইতিহাসের কথা এসেছে। কোনোটায় দেশ স্বাধীন করার জন্য কিশোর মনে যুদ্ধে যাওয়ার আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। আবার কোনোটিতে এসেছে স্বপ্নের কথা। একই সঙ্গে কোনোটা হাসির গল্প, কোনোটা কান্নার। আনন্দ-বেদনা-আবেগ-আকাঙ্ক্ষার সম্মিলন ঘটিয়েছেন লেখক। তবে কোনোটাই কিশোর বয়সের বাইরে যায়নি।
উপনিবেশ কাঠখোট্টা বিষয়। আমাদের এ উপমহাদেশ আড়াইশ' বছরেরও আগে ইংরেজদের দখলের ঘটনা হয়তো অনেকেরই অজানা। অথচ বিষয়টিকে লেখক যেভাবে 'উপনিবেশ টুপনিবেশের গপ্পো'র মাধ্যমে শিশুদের কাছে উপস্থাপন করেছেন, তা লেখকের অসাধারণ লেখনশৈলীরই প্রমাণ। 'কুকুরদের শোকসভা'য় আমাদের প্রতিবেশী ও শিশুদের কাছে পরিচিত কুকুরদের ভাষাও তিনি শিশুমনেই উপস্থাপন করেছেন। 'ওয়াক থু' গল্পে কেবল হাত-মুখ ধোয়ার পদ্ধতিই শেখানো হয়নি, শেষ পর্যন্ত 'ওয়াক থু' যে মগ নাম 'ওয়াং থু'তে পেঁৗছেছে সে মোচড়টাও দেখার মতো। তবে শিশু-কিশোর মন সর্বদাই ছবি আঁকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার কাছে ছবির মতো ভাসে। মানুষের জীবনও একেকটা ছবির মতো। 'আরেক সূর্যোদয়'-এ কিশোর ফুল্ল সে ছবিই এঁকেছে। গল্প একেক রকম। মাথা একটাই। লেখকের মাথায় ভিড় করা গল্পগুলো তার তুলির আঁচড়ে ফুটে ওঠে। লেখক উপস্থাপন করেন, চরিত্র দেন, নাম দেন। পাঠক ঠিক করেন। এভাবে গল্প চূড়ান্ত করেন। 'স্বর্ণদ্বীপের ছেলে' হয়তো শিশু-কিশোরদের জন্য। কিন্তু বইটি যে কারও পড়েই ভালো লাগবে। লেখকের শব্দচয়ন, বাক্য গঠন, কাহিনী বর্ণনার ধরন অসাধারণ। শিশুতোষ শব্দ ব্যবহারে তার নিজস্ব ঢং রয়েছে। তবে হাত-মুখ ধোয়ার তালিম দিতে গিয়ে তিনি একটা সাবানের নাম উল্লেখ করেছেন। অনর্থক কোনো কিছুর বিজ্ঞাপন না দেওয়াই শ্রেয়। গল্পগুলোতে কিছু ইংরেজি শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। গল্পের তালে হয়তো সেগুলো ঠিকই আছে এবং শিশু-কিশোররাও হয়তো সেগুলোর অর্থ খুঁজে বের করবে। তারপরও তাতে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
পুরো বইতে লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রকৃতি। আমাদের দেশের প্রকৃতি, তার পরিবেশ ও সৌন্দর্য, গ্রামের মাটি ও মানুষের কথা এসেছে গল্পগুলোতে। নদী, মাছ, সূর্য, প্রজাপতি, জোনাকি, গাছ, গরুর দুধ, কৃষক, গ্রাম, ছবি, পুকুর ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসেছে চমৎকারভাবে। নানা প্রসঙ্গে বিভিন্ন উপমা, উদাহরণের ব্যবহার গল্পগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে। বইটির নাম নেওয়া হয়েছে এর প্রথম গল্প 'স্বর্ণদ্বীপের ছেলে' থেকে। গ্রামের স্বর্ণদ্বীপ ফেলে যে ছেলেটির আশ্রয় হয়েছে শহরের রেলস্টেশন ও ফুটপাতে। তার সঙ্গে দেখা হলেই সে স্বর্ণদ্বীপের গল্প শোনায়। সোনার টুকরো যে দ্বীপে তার বাবা ছিল, মা ছিল, পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়ে ছিল। তার বাবা লাঙল চালাত, গরুর দুধ তারা খেত, অপরূপ সৌন্দর্যের আধার সে দ্বীপসহ সবই হারায় ছেলেটি। নদীর ছোবল তার সব শেষ করে ফেলেছে। তারপরও সে স্বপ্ন দেখে।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।