Mahfuzur Rahman Manik
দুঃসহ প্রহর শেষে
এপ্রিল 24, 2015

44_100উপন্যাস জীবনের কথা বলে। জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলোই লেখকের তুলির আঁচড়ে বাস্তব হয়ে উঠে উপন্যাসে। উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠক নিজেকে একেকটি চরিত্রে ভাবেন। এ ভাবনা কেবল নিজের জীবনের সঙ্গে মেলার জন্যই নয়, একই সঙ্গে ওই চরিত্রের মতো হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও। জাবেদ আমিন 'কার্নিশে শিহরণ' উপন্যাসটি যেভাবে রেহান আহমেদের বীরোচিত কর্ম দিয়ে শুরু করেছেন সে আকাঙ্ক্ষা থেকে পাঠক হয়তো ক্ষণিক নিজেকে রেহান ভাবতে পারেন। অবশ্য ট্রেনের বীরত্ব আর একটি ব্লাড ব্যাংক সুন্দরভাবে পরিচালনার চিত্র দেখার পর যখন তার বাস্তব জীবন সংগ্রামে পাঠক ঢুকে পড়বে তখন কিছুটা কষ্টই হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর দুই বছর পর্যন্ত বেকার থাকার কষ্ট ও সামাজিক বাস্তবতা সত্যিই কঠিন। সে সময়টায় অনেকের মতো রেহানেরও আয়ের একমাত্র উৎস টিউশনি। জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় সেখানেই তার শিক্ষার্থীর মা মুনমুন সরকার বাঁচার জন্য নির্ভরশীল হিসেবে পায় রেহানকে। পরকীয়ার এ হাতছানির মাঝেই রেহানের সামনে আসে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের হারানো নবনীতাকে, যদিও তার দেখা তখন সেভাবে মিলেনি। এর মধ্যেই মুনমুন সরকার রহস্যজনকভাবে মারা গেলেও দায় পড়ে রেহানের ওপর। তার মৃত্যু রহস্যই উপন্যাসকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে। এর মধ্যেই উঠে এসেছে রেহানের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেম, রাজনীতি, সাংসারিক জটিলতা ও এক নেতার সাহায্যে ফেরারি আসামি হয়ে বিদেশ যাত্রার চিত্র। উপন্যাসের অর্ধেকের পরে এসে বিদেশে রেহানের পরিণতিতে পাঠক চমকে যাবেন। তবে তার চেয়েও বেশি আশ্চার্যান্বিত হবেন তার বেঁচে থাকার খবরে। এর মধ্যেও রহস্য সেই পরকীয়া। যদিও অবশেষে মুনমুন সরকারের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটিত হয়। একই সঙ্গে রেহান উদ্ধার করে নবনীতাকে।
উপন্যাসটির ঘটনাবপ্রবাহে প্রাত্যহিক জীবনের নানা জটিলতা, সামাজিক আভিজাত্য, রাজনীতির অন্য অধ্যায়, জীবনের সংগ্রাম সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মারামারি-দলাদলির ঘটনা বর্ণনায় ছাত্ররাজনীতির কুৎসিত চিত্রও পাঠক পাবেন। পুরুষশাসিত এ সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের করুণ চিত্রও উপন্যাসটিতে ভালোভাবেই ধরা দিয়েছে। আর জীবনের নানা মোড় ও সংকটে মানুষের টিকে থাক, তার ওপরে ওঠা ও নিচে নামার সিঁড়িও দেখানো হয়েছে এখানে। কার্নিশে শিহরণ উপন্যাসটিতে পাঠক সবই পাবেন। একে যেমন প্রেমের উপন্যাস বলা যায় তেমনি সামাজিক উপন্যাস বললেও যথার্থ হবে। এমনকি রহস্য উপন্যাস বললেও অত্যুক্তি হবে না। এর প্রতিটি পরতে পরতে নতুন নতুন মোড় আর রহস্যে পাঠক বুঁদ না হয়ে পারবেন না। সত্যিই এটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো উপন্যাস।
জাবেদ আমিন উপন্যাসজুড়ে নানা সাদৃশ্য দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। 'মদিরা দৃষ্টি', 'জোঁকের মুখে নুন', 'নেড়ী কুকুরের জীবন', 'পুতুলের কান্না' অন্যতম। উপন্যাসটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইংরেজি শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার লক্ষণীয়। উপন্যাসের শেষ দিকে এসে মুদ্রণজনিত কিছু ত্রুটি পাঠকের চোখে পড়বে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে লেখক বোধ হয় ভালোবাসার জয়ই চেয়েছেন। সার্থকতার সঙ্গে সেই জয়ের গানই গেয়েছেন তিনি। উপন্যাসের নায়ক রেহান ও নায়িকা নবনীতার ওপর বছরের পর বছরের যে ধকল, কষ্ট, সংগ্রাম গেছে সে দুঃসহ প্রহরের সমাপ্তিই উপন্যাসটির সমাপ্তি। জাবেদ আমিনের ভাষায়ই তা শুনি, 'রেহান হাতের ফোনের দিকে তাকায়। অন্য হাতে নবনীতার হাত। একটা নতুন জীবনের অদূরেই কোথাও একটা মৃত্যু নিঃশব্দে পায়চারী করে। রেহান দুটো চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়। তার গোপন সেই অনুভবে পৃথিবীর সমস্ত সুখ ও কষ্টের আদল এক ও একাকার হয়ে যায়।'

 

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।