Mahfuzur Rahman Manik
প্রশ্ন ফাঁস: গোড়ার বদলে আগায় পানি ঢালা?

Question-outবিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। তবে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ধারা নতুনই বলতে হবে। আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। কর্তৃপক্ষ সব অভিযোগ নাকচ করলেও ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রে ব্যবস্থা না নিয়ে পারেনি। পরীক্ষাটি ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করতে বাধ্য হয়। কর্তৃপক্ষ অন্যান্য পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয় উড়িয়ে দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও অভিযোগ যে সত্য তা সংশ্লিষ্টদের জানার বাকি নেই। শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যার কয়েক বিষয়ে তা প্রমাণসহ সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়েছেন এবং সেটা প্রকাশও হয়েছে। সর্বশেষ ২৫ মে অনুষ্ঠিত গণিত (তত্ত্বীয়) পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে আগের দিনই। এ নিয়ে আগের দিন বুয়েটে প্রতিবাদও হয়। সংবাদমাধ্যম বিষয়টি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের নজরে আনলেও এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাননি বলে উড়িয়ে দেন। অথচ বাস্তবে সেসব প্রশ্ন মিলে গেছে।

প্রশ্ন ফঁাসের বিষয়ে শুরু থেকেই কর্তৃপক্ষের এ ধরনের চোখ বন্ধ করা ভাব যতটা বিস্ময়কর তার চেয়েও অদ্ভুত এ প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানোর সুপারিশ। ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র প্রশ্ন ফাঁসের পর শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায়, 'অত্যন্ত শক্তিশালী তদন্ত কমিটি' গঠন করা হয়। মন্ত্রী 'এবার যে কোনো মূল্যে প্রশ্ন ফাঁসের হোতাদের খুঁজে বের করা হবে' প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও প্রশ্ন ফাঁসের উৎস এবং এর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে পারেনি তারা। উল্টো এ কমিটি প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে যে সুপারিশ করতে যাচ্ছে অদ্ভুত এবং হাস্যকরই নয়, তা বাস্তবায়ন করাও কার্যত অসম্ভব। কমিটি একমাসেরও বেশি সময় পায়। এ সপ্তাহে কমিটি শিক্ষামন্ত্রীর কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। তবে কমিটির করা সুপারিশ ২৩ মে সংবাদমাধ্যম হতে জানা যায়। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, দেশের প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নগুলো আলাদাভাবে প্রণয়ন। একদিনে দুটি পরীক্ষা গ্রহণ এবং পরীক্ষার দিন সকালে ই-মেইলে প্রশ্ন পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো।

সুপারিশগুলো প্রকৃত অর্থে গাছের গোড়ায় না তাকিয়ে আগায় পানি ঢালার মতোই। প্রকৃতপক্ষে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তা বের না করলে সুপারিশ কতটা কার্যকর। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে 'শর্ষের ভেতরেই ভূত' থাকলে এগুলো গ্রহণ অসম্ভবই বটে। সৃজনশীল প্রশ্ন হয়তো প্রত্যেকটি বোর্ডই চাইলে আলাদাভাবে করতে পারে। কিন্তু পরীক্ষার দিনই প্রশ্ন ছাপিয়ে, সকালে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশকে কী বলা যায়। এটা যে হাস্যকর তা কমিটিরই এক সদস্যের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সে সদস্য সংবাদমাধ্যমকে বলছেন, 'বিষয়টি নিয়ে প্রথমে কেউ কেউ হাসাহাসিও করতে পারেন। কিন্তু প্রযুক্তির মাধ্যমে এটি সম্ভব।' কথা হলো আমাদের সব পরীক্ষার কেন্দ্র এখন পর্যন্ত প্রযুক্তিবান্ধব হয়েছে কি? দেশের সব কেন্দ্রে সকালে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠালে তা প্রিন্ট করে পরীক্ষা নেওয়ার মতো সামর্থ্য কতটা আছে তা বলাই বাহুল্য। প্রতিটি কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীর সংখ্যাটা কী কমিটির মাথায় রেখেছে? তার ওপর বিদ্যুৎচালিত কম্পিউটার এবং অন্য প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারে সব জায়গায় যথাসময়ে বিদ্যুৎ থাকার নিশ্চয়তা কে দেবে। যন্ত্রচালিত যে কোনো ডিভাইস কখন নষ্ট হয়ে যায় তারও ঠিক নেই। সকালে ই-মেইলে প্রশ্ন গ্রহণ করে তার প্রসেসিংয়ের জন্য যে ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তি দরকার তা সবখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে কিনা তাও দেখা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পরীক্ষাগুলোসাধারণত সকাল ১০টায় হয়। তার আগে সকাল কয়টায় প্রশ্ন পাঠানো হবে, কখনই-বা প্রিন্ট দেওয়া হবে; অল্প সময়ের মধ্যে সব ঠিক করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেওয়া সম্ভব কি-না তা ভাবতে হবে। কোনো কেন্দ্র যদি কোনো কারণে তা না পারে তখন কী হবে।

Samakal-news-question-out
সমকাল প্রতিবেদন, ২৩ মে ২০১৪

আর একই দিনে দুটি পরীক্ষা হলে তা তো আরও অসম্ভব। একদিন দুটি পরীক্ষার যৌক্তিকতাই-বা কোথায়। এর সঙ্গেপ্রশ্ন ফাঁসের কোনো সম্পর্ক স্পষ্ট নয়। উল্টো শিক্ষার্থীদের জন্য এটা মানসিক চাপ ছাড়া কিছু নয়। এখন যেখানে প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার মধ্যে দুই-তিন দিন পর্যন্ত গ্যাপ দেওয়া হয়, সেখানে একই দিন দুটি পরীক্ষা নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। পরীক্ষার সময় কমিয়ে আনার স্বার্থে প্রয়োজনে প্রতিদিন পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে।

তবে এর বাইরে ভালো কিছু সুপারিশও রয়েছে কমিটিরপ্রতিবেদনে। প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবারই সরকারি গোয়েন্দাদের মাধ্যমে নিরাপত্তা ছাড় নেওয়া, প্রশ্নপত্রের প্যাকেট উন্নত করে নিরাপত্তা ট্যাগ ব্যবহার করা, প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলার দায়িত্বরত ব্যক্তি ছাড়া প্রতিনিধির মাধ্যমে তা না খোলা, যেসব জায়গা থেকে প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয়, সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট রাখা ইত্যাদি। এ ছাড়াও সুপারিশে আরও কী আছে তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হলে হয়তো জানা যাবে। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রশ্ন ফাঁসের উৎস খুঁজে বের করা। এর সঙ্গে আসলেই কারা জড়িত তা বের করতে না পারলে এসব সুপারিশ কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর আন্তরিকতা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন নেই। বরাবরই তিনি প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন এবং বিষয়টি নিয়ে তিনি সংবাদপত্রে জাফর ইকবাল স্যারের লেখার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেনও। তারপরও অনেক ক্ষেত্রে আরও কার্যকর ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি। বিশেষ করে যখনই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ আসে তাকে জরুরিভাবে আমলে নেওয়া প্রয়োজন। প্রশাসনের উদাসীনতা কিংবা গা বাঁছানোর ভাবও এক্ষেত্রে বলা আবশ্যক। আসলে অন্ধ হলেই তো প্রলয় বন্ধ হয় না। প্রশ্ন ফাঁস জাতির জন্য কতটা বিপদসংকেত তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। যে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড সে শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রশ্ন ফাঁসই যথেষ্ট। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে এটি রোধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। এর জন্য তাড়াহুড়ো করে কিছু করলে চলবে না; বাস্তবসম্মত, কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদের জন্য যথাযথ সুপারিশ প্রয়োজন।

  • ছবি- সমকাল
ট্যাগঃ , , , , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।