Mahfuzur Rahman Manik
রাষ্ট্রহীন মানুষের কথা শুনুন- দীপ্তিমান সেনগুপ্ত
নভেম্বর 23, 2013

borders-peopleসবাই জানেন, ছিটমহল সংকট দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঝুলে রয়েছে। ভারতের মন্ত্রিপরিষদের নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি সম্প্রতি দুই দেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থন এবং ছিটমহলের মতো গুরুতর মানবিক সমস্যা সমাধানে সংবিধান সংশোধনে উদ্যোগী হওয়ার পর বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।
আমরা এও জানি, বাংলাদেশে ভারতের ছিটমহল রয়েছে ১১১টি আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে সীমান্তের এপাশে। মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন ভূখ-গুলোর অধিবাসীরাও সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে আসছে। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রটোকলে ছিটমহলগুলো বিনিময়ের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে চুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতিই দেখা যাচ্ছে। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপে রাখতে ইস্যুটি ব্যবহার করছে; অন্যদিকে বিজেপি বিষয়টি নিয়ে কৌতুককর খেলায় মেতেছে। আর সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত যারা, সেই ছিটমহলবাসীদের পুরো প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছে।
ছিটমহলবাসীদের প্রধান সমস্যা হলো পরিচয় সংকট। তারা সত্যিকারের রাষ্ট্র-পরিচয়হীন। তাদের না আছে ভোটার আইডি কার্ড, না আছে পাসপোর্ট কিংবা পরিচয় প্রমাণের অন্য কোনো অফিসিয়াল কাগজপত্র। এ অবস্থায় ভারতের সাঁইত্রিশ হাজার আর বাংলাদেশের চৌদ্দ হাজার ছিটমহলবাসী চাকরি পাচ্ছে না, সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারছে না, এমনকি স্বাস্থ্যসেবাও পাচ্ছে না। পাশাপাশি মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এসব ছিটমহলবাসীর পক্ষে মৌলিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়াও অসম্ভবÑ এ এক সত্যিকারের মর্মান্তিক পরিস্থি’তি।
ছিটমহল সংকট ঘিরে রাজনীতি তো রয়েছেই; অপরাপর স্বার্থও কি দুই দেশের সীমান্ত চুক্তির অনুসমথর্ণ বিলম্বিত করেছে? আসলে ছিটমহলগুলোতে আনুষ্ঠানিক প্রশাসন কাজ করতে না পারায় সমান্তরালভাবে একটি দুষ্টচক্র প্রশাসন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে ছিটমহলগুলো সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। চোরাকারবারিরা তাদের ভাগবাটোয়ারার পয়েন্ট হিসেবে এগুলোকে ব্যবহার করে। ফেনসিডিলের কারবার তো এখানে ব্যাপক। আমাদের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেবল এসব চোরাকারবারি ও অপরাধীদের ইনফরমার হিসেবে ব্যবহার করেই সন্তুষ্ট। সুতরাং এটা অবশ্যম্ভাবী যে, যারা বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে ফায়দা লাভ করছে, তারা চাইবে না সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হোক। আর এমন অরাজক অবস্থায় সবচেয়ে ভুক্তভোগী ছিটমহলের সাধারণ অধিবাসী।Chitmohol
এমন পরিস্থিতিতে বিজেপির একটি প্রস্তাব হচ্ছে, ছিটমহলগুলোর অধিবাসী বিনিময় হোক। আমি মনে করি, এক দেশের ছিটমহলবাসীকে অন্য দেশে বসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বিনিময় করার প্রস্তাব খুবই অমানবিক। আসলে বিজেপি চাচ্ছে এই অবস্থা চলতে থাকুক। তারা ছিটমহলগুলোর মানবিক সংকটের বিষয়ে যেন সম্পুর্ণভাবে বধির। তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন কী করছিল? আবার কেউই জানতে চাইছে না যে, ছিমহলবাসী কী চায়? তাদের সঙ্গে কথা না বলে, তাদের আলোচনার টেবিলে না রেখে কীভাবে এর সমাধান হবে? আমার মনে হয়, ছিটমহল সংকট নিয়ে বিজেপির কোনো অবস্থানই নেই।
বস্তত ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয়ক কমিটির তরফে আমাদের কেবল একটিই দাবি ভারত সরকারের উচিত নিজ থেকেই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই গণতান্ত্রিক দেশ; কিন্তু ছিটমহলের রাষ্ট্র্রহীন ৫১ হাজার অধিবাসীর সেখানে প্রতিনিধিত্ব নেই।
আমরা রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে থেকে তাদের জন্য সমর্থন সৃষ্টির চেষ্টা করেছি। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এর একটি আইনগত সমাধানই থাকতে হবে। কেবল দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা একটি মানবিক সমস্যা সমাধানেই নয়; বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পারস্পারিক সুবিধাজনক অবস্থানের জন্যও ছিটমহল সংকটের সমাধান জরুরি।
দীপ্তিমান সেনগুপ্ত : ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয়ক কমিটির কনভেনর

  • সমকালে প্রকাশিত ৪ অগাস্ট ২০১২
  • ৩ অগাস্ট ২০১২টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রদত্ত সাক্ষাতকার থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।