Mahfuzur Rahman Manik
স্টপ শিশুশ্রম

childWorkerরনিকে না চিনলেও চলবে। কতটা উচ্ছল ছেলেটা। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর রনির একজন কাস্টমার উপযুক্ত সেবাটাই চান। রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলেই সুন্দর করে সালাম দেয়। সালাম দিয়েই ক্ষান্ত হয় না। চেয়ার দেখিয়ে দরদমাখা কণ্ঠে বলে, 'বসেন স্যার।' এই 'স্যার'দের ফরমায়েশ খাটতেই দিন যায় তার। চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ত আভা স্পষ্ট। কেবল চালাক শব্দটা যেন তার পক্ষে খাটে না। এর সঙ্গে আরও কিছু জুড়ে দেওয়াটাই যথোপযুক্ত। কিছু জিজ্ঞেস করলে অসাধারণ ভঙ্গিতে জবাব দেয়। বিস্তর কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি কোনোদিন। খেয়েছো? জি স্যার। কতইবা বয়স। বাংলাদেশের শিশুর সংজ্ঞায় যে বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তার শেষ সীমার অর্ধেকের চেয়ে কিছু বেশি হবে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ থাকলেও পোশাক-পরিচ্ছদ তার উল্টো। ছেঁড়া এবং নোংরা দুটি অভিধাই এখানে খাটবে। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক, কাটার সময় যেন বহু আগেই পেরিয়েছে। তারপরও অশোভনীয় এ বড় চুলগুলোকে হাত দিয়ে মাথার সামনের দিক থেকে পেছনে চালান করে দেয়। যেন এটা একটা স্টাইল। রেস্টুরেন্টই তার জগৎ। খুব বড় কাজও সে করে না। রেস্টুরেন্টে আসা কাস্টমারদের খাবার দেওয়ার চেয়ে পানি কিংবা সালাদ দেওয়া বা এ জাতীয় সাধারণ কাজই তার দায়িত্ব।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। রনিকে দেখলে, তার কথা শুনলে, মনে হয় এদের দ্বারাই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ হতে পারে। কিন্তু এ সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ আজ রেস্টুরেন্টের কম দামি একজন কর্মী। পেট পুরে খাওয়াই এখন তার জীবনের চ্যালেঞ্জ। জাতির ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হবে কি নিজের জীবন নিয়েই টানাটানি। রনি যে সময় রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবারে সাহায্য করছে সে সময় তার স্কুলে থাকার কথা। রাতের খাবারের সময় তার পড়ার টেবিলে থাকার কথা। স্কুলে গেলে এখন হয়তো তার মাথায় থাকত পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার চিন্তা। জানা নেই কোন ভাগ্য রনিকে এই স্কুলে যাওয়া আর পরীক্ষার চিন্তা থেকে বাইরে রেখেছে। তার সমপর্যায়ের কেউ যখন স্কুলে যায়, তখন কেমন অনুভূতি হয় তাও জানা নেই। হয়তো প্রশ্ন করলেই গড়গড় করে বলে দেবে সে।
রনি এখানে প্রতীকী নয়। বাস্তব চরিত্র এবং এর চেয়েও বাস্তব চরিত্রগুলো সমাজে ঘুরে বেড়ায় সকলের সামনেই। রনি তো রেস্টুরেন্টে কাজ করে। যখন দেখা যায় রনির চেয়েও ছোট কোনো শিশু ইটভাটায় অনবরত ইট মাথায় নিয়ে কাজ করছে; ঝালাই, ঢালাই কারখানায় ঝুঁকিতে কাজ করছে; আগুন নিয়ে কাজ করছে রি-রোলিং কিংবা জ্বলন্ত বয়লারে, তখন মনে হয় রনি বুঝি ভালোই আছে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কাকে বলে তা দেখা যায়। এর বাইরেও শিশুরা যে কত ধরনের কাজে জড়িত_ ওরা কাজ করছে ধাতব কারখানায়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে, প্লাস্টিক কারখানায়, অটোমোবাইল-গাড়ির গ্যারেজে, রিকশা-মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপে কিংবা মানুষের বাসাবাড়িতে।

ChildLabourএভাবে গুনতে গুনতে ক্লান্তি আসে কিন্তু শিশু শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্র কমে না। এরকম দেশে শিশুরা নাকি ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। শিশুশ্রমিকদের সাম্প্রতিক কোনো সঠিক হিসেব নেই। শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব থেকে জানা যায়, দেশে ১৭ ভাগ শিশু শ্রমের সঙ্গে জড়িত। হিসাব করলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৭৪ লাখের ওপর। এভাবে হিসাবের পর হিসাব করা যাবে। আবার শিশুনীতি দেখলে শিশুশ্রম বন্ধের কথাই পাওয় যাবে, বিশ্বজনীন মানবাধিকারেও শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। কোনোটাই কি কিছু কমাতে পেরেছে? অতঃপর আসে আজকের ১২ জুন শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। নানা অঙ্গীকার শোনা যায়। এ বছর সরকার বলছে, ২০১৬ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন হবে। আসলেই হবে কিনা জানা নেই । তারপরও আমরা আশায় থাকি। শিশুশ্রম বন্ধ হবে। স্বপ্ন দেখি রনিদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে।

ট্যাগঃ , , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।