Mahfuzur Rahman Manik
এসএসসির বর্ধিত ফি: ওদের খবর কেউ রাখে না
নভেম্বর 20, 2011

পাবলিক পরীক্ষা, বিশেষ করে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে গণমাধ্যমে আমরা কিছু অদম্য মেধাবীর কথা শুনি। যারা সংগ্রাম করে নানা প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে সর্বোচ্চ ফল করে থাকে। এই প্রতিকূলতা আর সংগ্রাম প্রধানত অর্থনৈতিক। কারণ আমাদের সমাজে পড়াশোনার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কটা খুব নিবিড়ভাবে জড়িত। আমরা দেখছি, প্রথম শ্রেণীতে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তাদের শতকরা সত্তর জনই এসএসসি পর্যন্ত ঝরে যায়, এ ঝরে পড়ার প্রধান কারণও অর্থনৈতিক। দরিদ্র পরিবার, যাদের প্রতিদিনের খাবারের বন্দোবস্ত করাই দায়, তাদের সন্তানদের পড়াশোনা তো দূরের বিষয়।
শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ বাবদ একটা ভালো অঙ্কের টাকা শিক্ষা বোর্ডকে দিতে হয়। বোর্ড বিভাগ অনুযায়ী শিক্ষার্থীপ্রতি ১০০০-১২০০ টাকা নির্ধারণ করে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য এটা একটা বোঝা। এর আগে সে প্রতি বছর যে পরীক্ষা দিয়ে আসছে কোথাও এ পরিমাণ টাকা বা এর অর্ধেক টাকাও তাকে দিতে হতো না। এখন সে এই টাকা দিতে বাধ্য, কারণ এটা পাবলিক পরীক্ষা। তার জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে সে যে করেই হোক টাকা জোগাড় করে ফরম পূরণ করে। কিন্তু সমস্যাটা অন্যখানে। শিক্ষা বোর্ড যে পরিমাণ টাকা নির্ধারণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এর দ্বিগুণ-তিনগুণ এমনকি ছয়গুণ টাকাও দাবি করে।
এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ ১৬ নভেম্বর শেষ হলো। এ সময়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংবাদপত্র ফরম পূরণে বিদ্যালয়গুলোর বর্ধিত ফি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কেউ বলছে, 'এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ ফি আদায়ে নৈরাজ্য', কারও ভাষায় 'এসএসসির ফরম পূরণে গলাকাটা ফি আদায়'। মজার বিষয় হলো বর্ধিত ফির এ নৈরাজ্য শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশের সর্বত্র। সমকালের ১৭ নভেম্বরের খবর_ 'এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ : ঠাকুরগাঁওয়ে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ' আর ১৬ তারিখের খবর হলো_ 'রাজশাহীর স্কুলগুলোতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়'। সারাদেশে বোর্ড নির্ধারিত সর্বোচ্চ ফি ১২শ' টাকার বেশি নয়। এ টাকাই রাজধানীতে হয়েছে ১৩ হাজার পর্যন্ত, আর গ্রামে সেটা দুই থেকে চার হাজার।
এটা শুধু এবারের চিত্র নয়, প্রতি বছরই এমনটা দেখা যায়। অতিরিক্ত টাকা আদায়ের ন্যায্যতা হিসেবে বেতন, সেশন ফি, কোচিং ও মডেল টেস্টসহ আরও অনেক খাত দেখানো হয়। ফেব্রুয়ারিতে এ পরীক্ষা হচ্ছে, ফলে সারাবছরের সেশন চার্জের নামে তিন-চার হাজার টাকা নেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়? আবার কোচিং ও মডেল টেস্টের নাম করে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হবে কেন? এমনকি যারা বিদ্যালয়ে কোচিং করবে না তারাও ফি দিতে বাধ্য। মার্চ পর্যন্ত বেতনও বা কেন নেবে, শিক্ষার্থীরা তো নভেম্বর থেকেই বিদ্যালয়ের বাইরে। এ ছাড়া এ সময় বিদ্যালয় যে সেবা তাদের দেবে তার টাকা কোচিংয়ের নাম দিয়েই নেওয়া হচ্ছে। বলা যায়, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে বিদ্যালয়গুলো টাকা আদায় করছে।
নির্বাচনী পরীক্ষায় যারা অকৃতকার্য হয় তাদের সঙ্গে বিদ্যালয়গুলোর আচরণ দেখার মতো। নির্বাচনী পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী দু'একটা বিষয়ে অকৃতকার্য হতেই পারে। তাই বলে তাকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না, এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও মূল পরীক্ষায় এ-প্লাস পেয়েছে। এটা আবার বিদ্যালয়গুলোর টাকা আদায়ের আরেক খাত। রাজধানী তো বটেই, সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর_ গ্রামেও অকৃতকার্যদের বিষয়প্রতি দেড় থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। এমনকি এর বাইরে অকৃতকার্য বিষয়ে সিকিউরিটি মানি নামে অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা নিয়েছে কোনো কোনো বিদ্যালয়।
বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা শেষ সুযোগ হিসেবে যত পারছে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নিচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শিক্ষকরাও সোৎসাহে টাকা আদায়ে চাপ দিচ্ছেন। এর মানে এই টাকার একটা অংশ তাদের পকেটেও যাবে। আর কর্তৃপক্ষও টাকা আদায়ে মরিয়া। কোনো কোনো জায়গায় তো তারা অভিভাবকদের হুমকি দিয়ে বলছে, যারা বিদ্যালয় নির্ধারিত ফির এক টাকাও কম দেবে তাদের সন্তানদের ফরম পূরণ করা হবে না। এসব খেলা আমরা যেমন দর্শক সারিতে বসে দেখছি, তেমনি দেখছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বছরের পর বছর ধরে বিদ্যালয়গুলোর এসব স্বেচ্ছাচারিতা চলছে, অথচ কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের দায়িত্ব থাকলেও তারা এ পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানি না।
একজন অভিভাবক কত কষ্ট করে টাকা দেয়, তা বলাই বাহুল্য; যাদের ভূরি ভূরি টাকা আছে তারা ছাড়া। নিজেদের অভিজ্ঞতায়ই আমরা দেখেছি, নিজেরা না খেয়ে, না পরে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে এনে, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার করে; এমনকি নিজেদের জায়গা-জমি বিক্রি করে হলেও অভিভাবক সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালান, তার ফরম পূরণের টাকা জোগাড় করেন। টাকার পরিমাণটা অভিভাবকদের সাধ্যের মধ্যে থাকলে এর জন্য তাকে অতিরিক্ত কষ্ট করতে হয় না। এর জন্য যেমন শিক্ষা বোর্ড তার ফি কমাতে পারে, পাশাপাশি এর বাইরে কোনো ফি বিদ্যালয় যাতে না নেয় তার নিশ্চয়তাও দরকার।
আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থী নিজে কীভাবে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করে, তা বোঝার জন্য অদম্য মেধাবীদের দিকে তাকানো যায়। যাদের কথা শুরুতেই বলা হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিক গত বছর জিপিএ-৫ পাওয়া জয়পুরহাটের নাসিরের কথা বলেছে, যার পরিবার দরিদ্র, পড়াশোনা চালানোর জন্য রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ নেয়। পড়ার জন্য তার একটি টেবিল নেই, রাতে পড়ার হারিকেন নেই, কুপি জ্বালিয়ে সে পড়েছে। ফরম পূরণের অর্ধেক টাকা সংগ্রহ করেছে স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে। এ রকম নাসিরের আমাদের সমাজে অভাব নেই।
আমরা সেসব নাসিরের কথাই জানি, যারা যুদ্ধ জয় করে এসেছে; কিন্তু এ রকম অসংখ্য নাসির আছে যারা এই সমাজের কাছে পরাজয় বরণ করেছে। যাদের ফরম পূরণের টাকা নেই। অভিভাবকদের কাছ থেকে চেয়ে পায়নি। অবশেষে বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়েছে। এরা হয়তো একটু সহযোগিতা পেলে জ্বলে উঠত। তাদের কথা গণমাধ্যমে আসে না। কারণ সবাই বিজয়ীর কথাই বলে। বিদ্যালয়গুলো কিংবা কর্তৃপক্ষ কি এদের দিকে একটু তাকাবে না?

সমকাল উপসম্পাদকীয় ২০ নভেম্বর ২০১১

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।


Warning: First parameter must either be an object or the name of an existing class in /home/mahfuzma/public_html/wp-content/plugins/bit-form/includes/Admin/Form/Helpers.php on line 119

Warning: First parameter must either be an object or the name of an existing class in /home/mahfuzma/public_html/wp-content/plugins/bit-form/includes/Admin/Form/Helpers.php on line 119

Warning: First parameter must either be an object or the name of an existing class in /home/mahfuzma/public_html/wp-content/plugins/bit-form/includes/Admin/Form/Helpers.php on line 119