Mahfuzur Rahman Manik
রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম:নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফেব্রুয়ারী 2, 2011


একটা তথ্য দিয়ে শুরু করা যাক, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেইসবুক এবং টুইটার পৃথিবীর প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ভাষা হতে বাংলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফেইসবুক বা টুইটারের এ স্বীকৃতি তাদের নিজস্ব নয়; তাদের ব্যবহারকারীরা ভোট দিয়েই বাংলাকে নির্বাচন করেছে। ইউনেস্কোও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে এ স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে, ১৯৯৯ সালের পর মিষ্টি ভাষার এ স্বীকৃতি। বাংলার এতসব স্বীকৃতির গোড়ার কারণ একটাই ‘রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম’। ভাষার জন্য রক্ত দেয়া আর সংগ্রামের নজির পৃথিবীতে বিরল। বিরল এ নজিরটিই বাংলার। যা সম্ভব হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বদৌলতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য যে আন্দোলন হয়েছে, তার মাধ্যমে একদিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে আমরা পেয়েছি, অন্যদিকে তার পথ ধরেই পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। ১৯৪৭ সালের চৌদ্দ অক্টোবর পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের তেইশ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনেই কুমিল্লার শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। সেখানেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীসহ উচ্চস্থানীয় অনেকেই তার বিরোধিতা করে। এ সংবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগারো মার্চে প্রতিবাদ সভা করে বিক্ষোভ করে। রাষ্ট্রভাষার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বলা চলে এখান থেকেই শুরু। ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ববঙ্গ সফরে আসলে সাতাশ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি ছাত্রসভায় এক ভাষণ দেন। সে সময় ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন) এর নেতৃবৃন্দ প্রদত্ত মানপত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালের পর ১৯৪৯ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের অন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম তীব্রতর হয়। নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীরা তাদের দাবিদাওয়ার জন্য তিন মার্চ হতে ধর্মঘট করেন। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এ ধর্মঘটে সমর্থন দেন। নয় মার্চ কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের ভিত্তিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। কর্মচারীরা কাজে যোগ দিতে চাইলে বাধা দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে কর্মচারীদের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। তারা শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনের সমর্থন দেয়। যৌথ সমর্থনে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের সমর্থনে আন্দোলন করার ফলে সাতাশ জন ছাত্রকে শাস্তি দেয়, যাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অন্যতম। বলে রাখার বিষয় হলো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকরাও ছিলেন। বলা চলে সামনে থেকে নির্দেশনা তাঁরাই দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তমদ্দুন মজলিশ এর কথা বলতেই হবে। এ সংগঠনটির উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। যার আহবায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম থেকেই বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতি এমনকি তদানিন্তন সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা অন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করার পূর্বে ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান ভাষা নিয়ে আরেক কাহিনির জন্ম দেয়। তারা গণশিক্ষা প্রসারের নামে আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের অপপ্রয়াস চালায়। সে সময় এর বিরুদ্ধে এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা ‘পাকিস্তান শিক্ষাবোর্ড ও বর্ণমালা বিশেষজ্ঞ কমিটি’র নিকট স্মারকলিপি প্রদান করে। পরে প্রতিবাদে সভা হয় কলাভবনে এবং ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক হল)। ১৯৫০ সালেও আরবি হরফের কার্যক্রম চলে। এ সময় বাংলার বিভিন্ন জেলায় আরবি হরফ বাংলায় শেখানোর জন্য বিশটি শিক্ষাকেন্দ্র খোলা হয়। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর খাজা নাজিমুদ্দিন তার স্থলাভিষিক্ত হন। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। এই নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের একুশে জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সম্মেলনে জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করে ঘোষণা দেন ‘টৎফঁ ঝযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ’ উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার এ বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে সেদিন যারা ‘না’ ‘না’ করেছিলেন, তারা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী। প্রতিবাদে ত্রিশ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ ডাকে ধর্মঘট করেন। এ পরিষদের আহবায়ক ছিলেন আবদুল মতিন। সেদিনই কয়েকটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় কর্মপরিষদ’। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাম মাহবুব আহবায়ক নির্বাচিত হন। তারা পুনরায় চার ফেব্রুয়ারি ছাত্রধর্মঘট ডাকেন। সেদিন সকলের সিদ্ধান্তে একুশে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। বিশ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পাকিস্তান সরকার ঢাকায় একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে। সেদিন ‘সর্বদলীয় কর্মপরিষদ’ সদস্যরা একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগলেও ‘বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ’ এ ব্যপারে ছিলো বদ্ধপরিকর। সারারাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে তার প্রস্তুতি চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোবলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনতা একুশে ফেব্রুয়ারিতে একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। যার মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি পেশ করা হয়। ছাত্ররা শৃঙ্খলার সাথে একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। দলে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক অতিক্রম করে তারা। হঠাৎ মারমুখী হয় পুলিশ। পুলিশবাহিনী আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করতে থাকে। ছাত্রজনতার ঢল নামে। বেপরোয়া পুলিশ গুলি করে। নিহত হন রফিক, জব্বার, বরকতসহ আটজন। শতাধিক আহত হন। এখবর শহরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শহরবাসী। সেদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বের আন্দোলনই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। ঊনত্রিশ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকে বাংলার স্বীকৃতির অভাব নেই। সারা পৃথিবী এখন বাংলাকে চেনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই তার কারিগর।

pataka, February2011

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।