Mahfuzur Rahman Manik
বিদ্যুত সংকটে গণদুর্ভোগ
এপ্রিল 7, 2010

বিদ্যুত সংকেট গণদুের্ভাগ

মাহফুজুর রহমান মানিক
ভয়াবহ বিদ্যুত সংকটে দেশ। লোডশেডিংয়ের নাকালে মানুষের ভোগান্তি চরমে। জনজীবনের অস্থিরতার পাশাপাশি কমছে উৎপাদন। বোরো মৌসুম চলছে, সেখানে ব্যাহত হচ্ছে সেচ কাজ, এইচ এস সি পরীক্ষার্থীরা বিপাকে। গার্মেন্টসসহ সকল শিল্পের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বোপরি এ সংকট আমাদের বিনিয়োগেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এবার ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে এককোটি ৮৭ লাখ মেট্রিকটন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। এর জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের তথ্য মতে, ২লাখ ৫৯ হাজার ৪৪টি সেচ পাম্প চালাতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন ১ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সব মিলিয়ে এখন বিদ্যুতের চাহিদা ৬ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। উৎপাদন পিডিবির মতে, সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি মেটাতে সরকার রেন্টাল বা ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো। বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া এনে এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিট প্রতি ২টাকার স্থলে খরচ হবে ১২-১৩ টাকা। অথচ এ প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমান মাত্র ২৬৫ মেগাওয়াট মাত্র। আর এ রেন্টাল বিদ্যুত দিয়ে কৃষক এবার উপকৃত হতে পারছেনা। কারন মে জুন মাসে এগুলোর সুফল পাওয়া যেতে পারে। এ অল্প পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার অনেক টাকা অযথাই গচ্ছা দিচ্ছে বলে বিশেষঞ্জদেও ধারনা। বিদ্যুত ঘাটতি মেটাতে সরকার ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার কথা বলেছে। কীভাবে করবে গ্যাস দিয়ে? অথচ গ্যাস সংকটই এখন বিদ্যুৎ সমস্যার প্রধান কারন। এখন বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্রই গ্যাস ভিত্তিক। বর্তমানে ১৯টি গ্যাস ক্ষেত্রের ৭৯টি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। এসব গ্যাস ক্ষেত্রের উৎপাদন ক্ষমতা পেট্রোবাংলার মতে, দুই হাজার মিলিয়ন ঘটফুট। শিল্প কারখানা, বেসরকারি, সরকারি, গৃহস্থালি, বিদ্যুত উৎপাদনসহ নানা কাজে গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। গ্যাসের ঘাটতি এতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের এ ঘাটতি থাকতে আবার গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কতটা যৌক্তিক। কারন কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গ্যাসের নিরাপত্তার গ্যারান্টি ছাড়াই সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১২০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের একটি ইউনিট উদ্বোধন করেন। সেখানে গ্যাস স্বল্পতার কারনে পরদিনই উৎপাদন ৫০ মেগাওয়াটে নেমে আসে। এমনিতেই এখন চট্টগ্রামের গ্যাসের অভাবে রাউজানে ২১০ মেগাওয়াটের ২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ৫৬ ও ৬০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র শিকলবাহায় বন্ধ আছে। এছাড়া গ্যাস সংকটে অনেক কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কমে গেছে। বিদ্যুাতের এ পরিস্থিতির কারনে রাজধানি ঢাকা সহ গোটা দেশেই ব্যাপক ভাবে বেড়েছে লোডশেডিং। গ্যাস সংকট তো আছেই সাথে সাথে দেখা দিয়েছে পানি সংকট। গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুৎ সমস্যায় অস্থির জনজীবন। তারওপর চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহ। গরম আস্তে আস্তে আরো বাড়ছে। সুতরাং ভোগান্তিও শেষ নেই। আমাদেও এ সমস্যা জাতীয় অসচেতনতার জন্যও তৈরি হয়েছে। বিদ্যতের জন্য বাংলাদেশ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল ফান্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছে । এ তহবিল থেকে যে পরিমান অর্থ পাওয়া যেত বিশেষজ্ঞদের ধারনা যে ফান্ড দিয়ে ৭০০ মেগাওয়াট পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুত ঊৎপাদন করা যেত। বিষয়টি হলো ১৯৯৬ সালে পাওয়ার সেল নবায়ন যোগ্য জ্বালানীর একটি নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সেটা অনুমোদিত হয় ১২ বছর পর ২০০৮ সালে সময়মতো এ নীতি বা¯তবায়ন হলে জিইএফ এর অর্থ পাওয়া যেত। যা দিয়ে ২৫০ মেগাওয়াট উইন্ড পাওয়ার সহ ১৫০ মেগাওয়াট সোলার বায়োগ্যাস থেকে ১৫০ মেগাওয়াট ও কো-জেনারেশন থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যেত। অথাৎ ৭০০ মেগাওয়াট ফ্রি বিদ্যুত আমরা হারিয়েছি।বিদ্যমান বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে গত বছর সরকার ডেলাইট সেভিং টাইম চালু করেছিলো যা জনগনের কাছে ডিজিটাল টাইম হিসেবে পরিচিতি। এমাসের ৩১ তারিখ থেকে আবার সেটি চালুর পরিকল্পনা সরকারের ছিল। কিন্তু জনগন, বিশেজ্ঞসহ নানাজনের রাঁধায় সেটি আর চালু হচ্ছে না। বা¯তবে দরকার ও নেই। কারণ গতবছরের অভিজ্ঞতায়ই তার অসারতা প্রমান হয়েছে। সরকার (সিএফ এল) তথা কম্প্যাক্ট ফ্লুরোসেন্ট লাইট বাল্বের কথা বলেছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এ বাল্ব কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করবে, সেটা যদি জনগনের কাছে পৌছানো হয়। ২ কোটি ৬৫ লাখ সিএফএল বাল্ব বিতরন করলে ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যূত সাশ্রয় হতো। সরকার সে পরিকল্পনা করলেও এখনও বাস্তবায়ন করেনি। বর্তমান বিদ্যুত কেন্দ্র গুলোর যন্ত্রপাতি মেরামত এবং পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। গ্যাস সংকটে নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করে বঙ্গোপসাগর সহ সম্ভাবনাময় বিভিন্নস্থানে একাজ করা যেতে পারে। গ্যাসের উপর নির্ভর না থেকে কয়লার উপর নির্ভরতা বাড়ানো প্রয়োজন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে ৫৮ শ মিলিয়ন টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে ৭৫% ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন। চীন ভারত সহ পৃথিবীর অনেক দেশই কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে খুব ভালোভাবেই। এজন্য আমাদের একটি সুষ্ঠু কয়লানীতি হওয়া আবশ্যক। দেশে এখনও কয়লনীতি চূড়াšত হয়নি। বলা হয় বাংলাদেশে ২০০/৩০০ কোটি মেট্রিকটন কয়লা মজুদ রয়েছে। যা দিয়ে অনায়াসেই দেশের বিদ্যুৎ সংকট মেটানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনার অভাবে সে কাজ ভালোভাবে এগুচ্ছেনা । সুষ্ঠু কয়লা নীতিমালা করে দ্রুত আমাদের এ জ্বালানি সম্পদকে রক্ষা করা দরকার।বিদ্যুতের বিষয়ে ব্যক্তিগত উৎপাদন পদ্ধতিতে জনগনকে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। এলাকা ভিত্তিক প্লান্ট স্থাপন, সেটা হতে পারে রিয়েল এষ্টেট কোম্পানী গুলোর এলাকা ভিত্তিক, কিংবা পৌরসভা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন। এগুলোকে পরে জাতীয় গ্রীডের সাথেও যুক্ত করা যায়।বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেন্টাল প্রক্রিয়া কিংবা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া কোন সমাধান নয়। বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় উৎপাদন, বিতরন, সরবরাহ এতো বিভাজন না রেখে এ গুলোকে এক সংস্থায় করে দেখা যেতে পারে।বিদ্যুত উৎপাদনে গ্যাস কয়লা এগুলো অনবায়নযোগ্য শক্তি। এগুলোর মজুদ ও আমাদের বেশি না। ইতিমধ্যেই গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আমাদের গ্যাস সম্পদ যা মজুদ আছে তা দিয়ে হয়তো কয়েক বছর চলবে। এরপর যে সংকট আসছে তা অত্যাšত ভয়াবহ। বিশ্বব্যাপী এ জ্বালানী সংকট ঘনীভুত হচ্ছে। এগুলোর প্রতি আমাদের নির্ভরতা এখনি না কমালে, দেশের বিপদ অত্যাসন্ন। এজন্য তেল গ্যাস কয়লার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে এর বাইরের জ্বালানি সম্পদের দিকে নজর দেয়া অত্যšত জরুরি। এর বাইরে রিনিউয়েবল এনার্জি তথা নবায়নযোগ্য শক্তিই রয়েছে বিকল্প। এ শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন সহজসাধ্য, তেমনি কম খরচ এবং পর্যাপ্তও। এ শক্তি কখনো নিঃশেষ হবে না। অবশ্য এ নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে যে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ যে শুরু হয়নি তা নয়। নবায়নযোগ্য শক্তি সমূহ হলো সৌরশক্তি, বায়ু প্রবাহ শক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তি, হাইড্রোজেন শক্তি, এছাড়া আরেকটি হতে পারে পারমানবিক বিদ্যুৎ শক্তি। বিকল্প শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে জৈব গ্যাস প্রযুক্তি ও সম্ভাবনার। জলবিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে দেশের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু আছে। এখানে ৭টি ইউনিটের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অšতর্ভূক্ত হিসেবে জোয়ার ভাটা কেন্দ্রিক বা তরঙ্গ বিদ্যুৎ পদ্ধতির কথাও বলা যায়। এসব পদ্ধতিতে ফ্রান্স, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ সমূহ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরকে কাজে লাগিয়ে তরঙ্গ শক্তির বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে। সৌরশক্তির ব্যবহার ও আমাদের দেশে বাড়ছে। সূর্যের রশ্মি থেকে আহরিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ১৫ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এবং এ শক্তি ব্যবহার করে প্রায় ৮ লাখ বাড়ি আলোকিত হচ্ছে। এ পদ্ধতি প্রধানত গ্রীড লাইন থেকে দূরবর্তী গ্রামীণ এলাকা সমুহ এবং চা বাগান গুলোতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অথচ এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের জন্য সহজ ও সুলভ। বিজ্ঞানীরা বলেছেন সূর্য এক বছরে পৃথিবীতে যে শক্তি সরবরাহ করে তা বিশ্বের পারমানবিক ফসিল জ্বালানি তথা কয়লা তেল, গ্যাস ইত্যাদির মিলিত শক্তির তুলনায় পনের হাজারগুন বেশি। হাইড্রোজেন শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের দেশে শুরু না হলেও বায়ু প্রবাহ শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষুদ্র প্রয়াসে হলেও শুরু হয়েছে। এরমধ্যে গ্রামীন শক্তির কক্সবাজারের চকোরিয়া চিংড়ি খামারের স্থাপনা এবং ব্রাকের বিভিন্ন উপকূলী এলাকায় ১১টি টারবাইন স্থাপন অন্যতম। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা আওয়ামীলীগের ইশতিহারে রয়েছে। রূপপুরের এ পারমানবিক কেন্দ্রের ব্যাপারে চীন ও রাশিয়ার আগ্রহ আছে।ু সরকার সে আলোচনা নিশ্চয়ই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ পদ্ধতি অত্যšত ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্য ও ঝুঁকিপূর্ন। এজন্য অনেকে একে স্বপ্নবিলাস বললে ও পত্রিকায় আমরা পড়েছি ইতিমধ্যে তা নিয়ে কথা শুরু হয়েছে।বিকল্প জ্বালানির কথা বললে জৈব গ্যাস প্রযুক্তিও সম্ভাবনাময়ী খাত। ১৯৯৬ গবাদি পশুছিল ২কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার। এগুলো থেকে যদি প্রতিদিন ২৪ কোটি পশু বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সে বর্জ্য দিয়ে প্রতিদিন অনেক জৈব গ্যাস উৎপাদন সম্ভব। এখন গবাদিপশুর পরিমান প্রায় ৫কোটি সুতরাং বলাই যায় এটা সম্ভব নয় ক্ষেত্র। এসব বিকল্প এবং সম্ভাবনাময় দিকগুলোকে কাজে লাগিয়ে ভালোভাবে উদ্যোগ নিলে, সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে যে লোডশেডিংমুক্ত দেশ গড়ার কথা বলেছে তা সম্ভব হতে পারে। তখন উন্নত বিশ্বেও মতো আমাদেও ডিকশনারিতেও লোডশেডিং নামে কোন শব্দ থাকবেনা। ২০১৪ না হলেও ২০২১ সালে ও কী আমরা সে স্বপ্ন দেখবো না?

সাপ্তাহিক প্রতিচিত্রে প্রকাশিত ২ এপ্রিল ২০১০

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।